‘তালা বন্ধ না থাকলে অনেক মানুষ বাঁচত’
নারায়ণগঞ্জ থেকে সৌরভ হোসেন সিয়াম: বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাশেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার ছয়তলার একটি ভবনে যে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান কারখানার ৫২ জন শ্রমিক-কর্মচারী, নিখোঁজ বহুসংখ্যক।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ভবনের চতুর্থ তলার সিঁড়ির দরজা বন্ধ ছিল। নিচতলায় আগুন জ্বলছিল। শ্রমিকরা সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে পারলে এত প্রাণহানি ঘটত না, অনেক মানুষই বাঁচত। ফায়ার সার্ভিস ও বেঁচে ফেরা শ্রমিকদের দেয়া তথ্যমতে, ভবনের নিচতলায় প্রথমে আগুন লাগে। নিচতলায় ছিল ফয়েল প্যাকেটসহ বিভিন্ন কার্টন। এসব সহজেই দাহ্য হওয়ার কারণে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভবনের অন্য তলায়।
শ্রমিকদের অভিযোগ, আগুন লাগার কিছুক্ষণ পরই ভবনের দুটি দরজা তালা বন্ধ করে দেয়া হয়। এর আগেই কিছু শ্রমিক কারখানা থেকে বেরিয়ে যান। আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়লে ভীত-সন্ত্রস্ত শ্রমিকরা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন ভবন থেকে। এই ঘটনায় আহত দুই নারীকে রাতেই পার্শ্ববর্তী ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই মারা যান তারা। পরে গুরুতর আহত আরও এক পুরুষ শ্রমিক মারা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, ৫টা ৪২ মিনিটে তারা অগ্নিকান্ডের খবর পান। ৩০ মিনিটের মধ্যেই তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এর আগেই আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। রাতেই ২৫ জন শ্রমিককে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছিলেন তারা। দুপুর দেড়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করেন তারা। অধিকাংশ মরদেহ ছিল ভবনের চতুর্থ তলায়। তখনও ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় আগুন জ্বলছিল। সেই আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে বিকেল ৫টার পর।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সেখানে সিআইডি ও পুলিশের টিম রয়েছে। জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ (কন্ট্রোল রুম) খোলা হয়েছে। সেখানে ডিএনএ টেস্ট করে পরিচয় নিশ্চিত করার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সজীব গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ্ আজাদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির নিচতলায় ছিল কার্টনের স্টোররুম। সেখানে কাগজের কার্টন, বোতল তৈরির কাঁচামাল, ফয়েল কাগজ ছিল। ভবনের দুই থেকে পঞ্চম তলায় টোস্ট, অরেঞ্জ জুস, কোমল পানীয়, লাচ্ছা সেমাই, লাচ্ছি, মটর ভাজা, চানাচুর তৈরি হতো। ষষ্ঠ তলায় ছিল স্টোররুম। ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার এডমিন ইনচার্জ সালাউদ্দিন মিয়া জানান, সেকশনের পাঁচটি ফ্লোরে চারশ’ শ্রমিক বিকেলে ওভারটাইম করছিলেন। সে ভবনের উপরের ফ্লোরে তাদের স্টোর। সেখানে কয়েক কোটি টাকার মালামাল রয়েছে।
শ্রমিকরা জানান, নিচতলার একটি অংশে নুডুলস তৈরি করা হতো। দ্বিতীয় তলায় তৈরি হতো টোস্ট। নিচতলা কিংবা দ্বিতীয় তলায় আগুনের সূত্রপাত। তবে নিচতলায় কাগজ ও প্লাস্টিকের কার্টন থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। উপরে সেমাই ভাজার তেল, ঘিসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থও ছিল।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কারখানায় প্লাস্টিক, ফয়েল, কাগজ, রেজিন, ঘি, খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের ক্যামিকেলসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ছিল। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগে এবং বেগ পেতে হয়।
আগুন নেভানোর পর সরেজমিন ঘুরে ও কারখানার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩৪ হাজার স্কয়ার ফুটের ভবনটিতে দুটি করে সিঁড়ি, গেট ও লিফট রয়েছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় পার্শ্ববর্তী ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত করে এমন একটি গেট রয়েছে। তবে ওই গেট অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে বলে জানান শ্রমিক ও কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা। তবে কারখানা ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা অপ্রতুল, দুর্যোগকালীন প্রবেশ ও বহির্গমন ব্যবস্থাও জোরালো ছিল না বলে প্রাথমিকভাবে নজরে এসেছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ভবনের আয়তন অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরালো ছিল না। ভবনের অবকাঠামোগত বিষয়েও তদন্তের দাবি রাখে বলে জানান তিনি।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কারখানায় শিশু ও কিশোর শ্রমিক কর্মরত ছিল। নিখোঁজ শ্রমিকদের তালিকার মধ্যেও অন্তত দশজন শ্রমিকের বয়স ১৮ বছরের নিচে পাওয়া যায়। শ্রম আইন অনুযায়ী ৮ ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও এই কারখানায় শ্রমিকরা টানা ১২ ঘণ্টা কাজ করতেন বলে জানান। তবে এই বিষয়ে সজীব গ্রুপের প্রধান নির্বাহী শাহান শাহ্ বলেন, অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বয়স বাড়িয়ে কারখানায় চাকরি নেন। আর ৮ ঘণ্টার বাইরে কাজের বেলায় ওভারটাইম হিসাব করা হয় বলে দাবি তার।
নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের ক্ষোভ
রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে গেলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন কারখানায় আটকে পড়া শ্রমিকদের স্বজনরা। শুক্রবার সকাল পৌনে এগারোটার দিকে তারা কারখানার অন্যান্য ভবন ও আশপাশের গাড়ি ভাঙচুর শুরু করেন। তাদের অভিযোগ ছিল, আগুন নেভাতে দেরি করছে ফায়ার সার্ভিস। তাদের কার্যক্রমে গাফিলতি রয়েছে। অন্যদিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও ভেতরে আটকা পড়া শ্রমিকদের তথ্য গোপন করছে বলে অভিযোগ ছিল ক্ষুব্ধ স্বজনদের। তারা স্থানীয় একটি আনসার ক্যাম্পেও হামলা চালায়। সেখান থেকে তিনটি শটগান লুট করে পার্শ্ববর্তী খালে ফেলে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার সেল ও কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এই ঘটনায় আনসার সদস্যসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এরপর দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ভবন থেকে মরদেহ বের করে আনা শুরু করলে আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠে নিহত শ্রমিকদের স্বজনরা। তাদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। আগের রাতেও মহাসড়কে ভাঙচুর চালান ক্ষুব্ধ স্বজনরা।
পৃথক তিন তদন্ত কমিটি
অগ্নিকান্ডের কারণ ও ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তর। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম বেপারীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক, পুলিশের একজন প্রতিনিধি এবং কলকারখানা অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের দাফন ও সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। এদিকে সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। তিনি শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন।
এর আগে বিকেলে র্যাবের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগুনের কারণ জানতে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদনে কারও গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।