Home পর্যটন পঞ্চগড়: পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার হাতছানি

পঞ্চগড়: পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার হাতছানি

কাঞ্চনজঙ্ঘা

রবিউল ইসলাম রিপন
পঞ্চগড়:
হাজার বছরের গৌরব-গাঁথা ও প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের অগণিত স্মৃতিময় জনপদ পঞ্চগড়। পুন্ড্র, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম শাসনামলের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জনপদ। পর্যটনের সব উপাদান বর্তমান থাকায় ও উত্তরের শীতপ্রবণ এই জেলার অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে দিন দিন ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বাড়ছে হিমালয়কন্যা খ্যাত পঞ্চগড়ের কদর। ফলে হিমালয় কন্যাকে পরিকল্পিত পর্যটন জেলা হিসেবে গড়ে তোলার দাবি উঠেছে।

ঢাকা থেকে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার দূরে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। হিমালয়ের পাদদেশে জেলাটির ভৌগোলিক অবস্থান হওয়ায় পঞ্চগড়কে বলা হয় হিমালয় কন্যা। খালি চোখে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা অবলোকন, পাহাড়ি ঢল থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলধারার নদী, সমতল ভূমির চা-বাগান, বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল আর প্রাগৌতিহাসিক নানা স্থাপনা আর দুর্গ পঞ্চগড়কে গড়ে তুলতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী হিসেবে।


পঞ্চগড়ের সর্ব উত্তরের উপজেলা তেতুলিয়ায় রয়েছে বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট। এখানে অবস্থিত বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটানের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র সম্ভাবনাময় দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর। প্রায় ১০ একর জমিতে ১৯৯৭ সালে নির্মিত হয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। বন্দরে ইমিগ্রেশন সুবিধা থাকায় অল্প সময়ে ভ্রমণ করা যায় ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনের মতো দেশগুলো। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জিরোপয়েন্ট দেখতে ভিড় করেন পর্যটকরা।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার, এভারেস্ট শৃঙ্গ ৭৫ কিলোমিটার, ভুটান ৬৪ কিলোমিটার, চীন ২০০ কিলোমিটার, ভারতের দার্জিলিং ৫৪ কিলোমিটার ও শিলিগুড়ি ৮ কিলোমিটার।
জেলার আরেক পর্যটন স্পট কাঞ্চনজঙ্ঘা। তেতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব হাতের কাছেই। শরতের শেষের দিক হতে শীত পর্যন্ত তেতুলিয়া ডাক বাংলোতে দাঁড়িয়ে উত্তরের মেঘমুক্ত আকাশে তাকালেই চোখে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মন হরণীয় মায়াবী দৃশ্য। মনোরম আবহে প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের মনে অপার্থিব মায়ার ঘোর সৃষ্টি করে।


তেতুলিয়া উপজেলার বুক চিরে বয়ে গেছে নয়নাভিরাম মহানন্দা নদী। এর তীর ঘেঁষে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর পিকনিক কর্ণার ও প্রায় ৩শ’ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গাছপালা কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এ স্থান। রয়েছে ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্য। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। অপূর্ব সুন্দরের রাজ্য পঞ্চগড়ের অনন্য আরেক দিক হলো এখানকার সবুজের নৈসর্গ চা বাগান। দেশের একমাত্র এখানেই সমতল ভূমিতে চা চাষ করা হয়। জেলার চা বাগানগুলোতে সবুজারণ্যে চা গাছ থেকে পাতা তোলার দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে আসে। পঞ্চগড় ইতিমধ্যে দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।


পর্যটকদের কাছে পঞ্চগড়ের আকর্ষণীয় জায়গা ও স্থাপনার মধ্যে আরও রয়েছে মোঘল স্থাপত্য মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বার আউলিয়ার মাজার, সনাতন ধর্মের বোদেশ্বরী মন্দির, ভূগর্ভস্থ পাথর তোলার দৃশ্য, ১৫০০ বছরের পুরাতন সুবিশাল মহারাজার দীঘি, দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রতœতও¦ নিদর্শন ভিতরগর দূর্গনগরী, এখানেই আছে বন বিভাগের বিশাল শালবন, আছে শালমারা বিল। পাথর সমৃদ্ধ রকস মিউজিয়াম , চতুর্থ চীন বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু,কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট এর আনন্দ ধারা।


জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার অপরূপ ছায়াঘেরা আর মন ছুঁয়ে যায় এমন একটি স্থান হল ময়নামতিরচর। করতোয়া নদীর কোলঘেঁষে প্রায় ৩৫ একর জমি জুড়ে বিসৃত এ বনাঞ্চল। যারা নৌকাভ্রমণ করতে চান তাদের জন্যও রোমাঞ্চকর হতে পারে করতোয়ার বুকে ডিঙ্গি নৌকা ভ্রমণ। সন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম রূপকার ও খ্যাতিমান নেত্রী দেবী চৌধুরানীর নামানুসারে দেবীগঞ্জ উপজেলায় আরও রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা খয়ের বাগান।
এছাড়া মৌসুমে এ জেলার ছোট-বড় কমলা বাগানগুলোতে রসালো কাঁচা-পাকা কমলাও পর্যটকদের কাছে এক বড় আকর্ষণ। এদিকে, ভূগর্ভে পাথর থাকায় এই জেলার পানি অত্যন্ত ঠান্ডা ও সুস্বাদু যা বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারকেও হার মানায়।


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হওয়ার পরও পঞ্চগড়ে পর্যটকদের জন্য গড়ে ওঠেনি কোনো উন্নতমানের হোটেল বা মোটেল। জেলা শহরে কিছু হোটেল থাকলেও সেগুলোয় নেই উন্নত সুযোগ-সুবিধা। জেলায় বেশকিছু ডাকবাংলো থাকলেও সেগুলোয় পর্যটকদের সংকুলান হওয়া সম্ভব নয়।
পঞ্চগড়ে পর্যটকদের আগমনে সরকারি রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ী, রিকশা-ভ্যান চালক ও আবাসিক হোটেলগুলোর বেশ আর্থিক উন্নয়ন হবে। এখন শুধু সরকারি তত্ত¦াবধানে হোটেল-মোটেল তৈরি আর স্পটগুলো সংরক্ষণ করা গেলে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় হবে হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়।
ট্রেন যোগাযোগ চালু হওয়ায় পঞ্চগড়ে পর্যটনশিল্পের নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। আশা করা যায় বিশ্বের মানচিত্রে পঞ্চগড় একটি অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পাবে।