Home রকমারি সংবাদ ৪০০ বছর আগে মহামারীতে বিক্রি করত ভুয়ো ওষুধ

৪০০ বছর আগে মহামারীতে বিক্রি করত ভুয়ো ওষুধ

১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে লন্ডনের আকাশে এক উজ্জ্বল ধুমকেতু দেখা গেল। যেমন বিশাল তার মুণ্ড, তেমনি ঝাঁটার মতো লেজ। শহরের লোক আতঙ্কে ক্রশ চিহ্ন আঁকতে লাগল বুকে। হাটে বাজারে বলাবলি করতে লাগল, এইবার ভয়ংকর কিছু ঘটবে। বাইবেলে যেরকম লেখা আছে, হয়তো সেইরকম প্রলয় হবে।

১৬৬৪ সালের সেই ধুমকেতু। সেযুগের শিল্পীর আঁকা।

ভারতে তখন বাদশা ঔরঙ্গজেবের রাজত্ব। মোগল সাম্রাজ্য উঠেছে উন্নতির শীর্ষে। সেই সঙ্গে সাম্রাজ্যে ভাঙনের ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছে। এই সময় দিল্লি, আগ্রা, কানপুর, লখনউ অথবা মুর্শিদাবাদ ছিল লন্ডনের চেয়ে অনেক বড় শহর। আয়তন, লোকসংখ্যা বা নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের দিক থেকে ভারতের মহানগরীগুলোর কাছে দাঁড়াতেই পারত না লন্ডন।

ব্রিটিশদের রাজধানীর আয়তন ছিল মোটে ৪৪৮ একর। তার পূর্ব, পশ্চিম আর উত্তর দিক ছিল দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণে ছিল টেমস নদী। ওই ঘেরা অংশের ভেতরে থাকতে লন্ডনের জেন্টলম্যানরা। গরিবদের বস্তি ছিল দেওয়ালের বাইরে। শহরে জঞ্জাল সাফাই হত কালেভদ্রে। রাস্তার দু’পাশে উপচে পড়ত খোলা ড্রেন। যত্রতত্র স্তূপ হয়ে থাকত জঞ্জাল।

‘৬৪ সালের শেষদিকে যখন সেই ধুমকেতু দেখা দিল, তখন লন্ডন শহরের বাস করত ড্যানিয়েল ডিফো নামে এক বালক। তার বয়স তখন চার। তাদের বাড়ি ছিল ফোর স্ট্রিট নামে একটা রাস্তার ধারে। তার বাবা জেমস ফো ছিলেন শহরের নামজাদা কসাই।

ধনী পরিবারের সন্তান হিসাবে ডিফোর জীবন আরামেই কাটার কথা ছিল, কিন্তু কাটেনি। তার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন লন্ডনে দেখা যায় ভয়াল প্লেগ মহামারী। তার দু’বছর বাদে শহরে হানা দেয় ডাচ দস্যুরা। ডিফোর যখন ১০ বছর বয়স, তখন তার মা দেহরক্ষা করেন।

যৌবনে ডিফো ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন। বিলাসে-ব্যসনে সব উড়িয়েও দিয়েছেন। অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। বরপণ হিসাবে পেয়েছিলেন বিপুল অর্থ। একসময় সরকারের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। পরে রাজদ্রোহের দায়ে পড়েছেন। পাওনাদারের ঋণ শোধ করতে না পেরে জেলে গিয়েছিলেন। শেষ বয়সটা খুব কষ্টে কেটেছিল। জীবনের এইসব ওঠাপড়ার মধ্যে চালিয়ে গিয়েছেন লেখালিখি।

মৃত্যুর ৪০০ বছর বাদেও তিনি অমর হয়ে আছেন ‘রবিনসন ক্রুশো’-র স্রষ্টা হিসাবে। এই উপন্যাসটি পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তাঁর আর একটি অল্প পরিচিত বই আছে। তার নাম ‘জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’।

১৬৬৪ সালে সেই যে উজ্জ্বল ধুমকেতু দেখা গিয়েছিল, তার কয়েক মাসের মধ্যেই লন্ডনে শুরু হয় প্লেগ মহামারী। শহরে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। সেই মহামারী নিয়ে ডিফোর বই প্রকাশিত হয় ১৭২২ সালে। প্লেগের সময় কী ঘটেছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে তাতে।

মহামারীর সময় ডিফোর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ। তাঁর পক্ষে কি অত মনে রাখা সম্ভব? এই নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করতেন। পরে জানা যায়, ডিফো বড় হয়ে কাকার কাছে শুনেছিলেন মহামারীর গল্প। কাকার নাম ছিল হেনরি ফো। তাঁর বাড়ি ছিল ইস্ট লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায়। তিনি মহামারীর সময় রাতে লন্ডনের পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন।

‘৬৪ সালেই লন্ডনে শোনা গেল, আমস্টারডাম ও রটারডামে প্লেগ শুরু হয়েছে। ‘৬৫-র শুরুতে রোগ এসে হাজির হল লন্ডনের দোরগোড়ায়। শুরুতে শহরের পাঁচিলের বাইরে গরিবদের বস্তিতে শুরু হল মহামারী। রোজ কবরখানায় আগের চেয়ে বেশি মৃতদেহ সমাধি দেওয়া হতে লাগল। হেনরি ফো হিসাব রাখতেন, কবে কোন সমাধিক্ষেত্রে কত মড়া আনা হয়েছিল। তা থেকে আন্দাজ করা যেত, কীভাবে ছড়াচ্ছে প্লেগ।

প্লেগ রুখতে পুরসভা জারি করেছিল লকডাউন। লন্ডন ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছিল। বাজার-হাট বন্ধ। ধনীরা আগেভাগে পালিয়ে গিয়েছে শহর ছেড়ে। প্রতিটি বাড়ির বাইরে তালা দিয়ে গিয়েছে পুরসভার লোক। কেউ যাতে বাইরে বেরোতে না পারে, সেজন্য ওই ব্যবস্থা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াচম্যান।

রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে শহরের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হেনরি ফো শুনেছেন, বাড়িগুলোর ভেতর থেকে ভেসে আসছে নারী ও শিশুদের আর্তনাদ। তার মানে সেই বাড়িতে হানা দিয়েছে প্লেগ। কেউ হয়তো মারা পড়েছে। কোনও কোনও বাড়ি একেবারে নিশ্চুপ। সেখানে সকলেই মারা গিয়েছে।

পুরসভার ওয়াচম্যানরা রোজ প্রতিটি বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখত। কেউ মারা গিয়েছে জানলে ঘড়ঘড় শব্দে আসত ডেড কার্ট। মৃতদেহ বহন করার গাড়ি। কবরখানায় বিরাট বিরাট ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছিল। তাতে গাদা করে ফেলে দেওয়া হত মৃতদেহ। পুরসভা নির্দেশ দিয়েছিল, প্রতিটি মড়াকে অন্তত মাটির ছ’ফুট নীচে কবর দিতে হবে। নইলে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা।

হেনরি ফো বলেছেন, একসময় মৃত্যুভয়ে মানুষ পাগল হয়ে উঠল। ভালমন্দ বোধ লোপ পেল। অনেকে পুরসভার পাহারাদারদের মেরেধরে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। এই সুযোগে পোয়া বারো হল প্রতারকদের। ভয়ে মানুষ বুদ্ধিসুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে। তাদের ঠকানো সবচেয়ে সোজা।

গোটা শহর প্লেগের নানা ‘ওষুধ’-এ ছেয়ে গেল। কেউ বেচতে লাগল পিল। কেউ বা বেচত ‘রহস্যময় দ্রবণ’। একদল লোক বলত, তারা ডাইনিবিদ্যার চর্চা করে এইসব ওষুধ শিখে এসেছে। ওষুধে আছে অল্প মাত্রার বিষ। সেই বিষ শরীরে প্রবেশ করলে পরে প্লেগের জীবাণু আর কিছু করতে পারবে না। শরীরে ঢোকা মাত্র মরে যাবে।

হাতুড়েরা শহরে রাস্তায় রাস্তায় লাগিয়ে দিল ওষুধের বিজ্ঞাপন। তাতে থাকত, ‘প্লেগের বিরুদ্ধে অব্যর্থ ওষুধ’, ‘বাতাসে ভাসমান জীবাণুর বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিষেধক’, ‘মহামারী প্রতিরোধী পিল’, ‘প্লেগ প্রতিরোধে অব্যর্থ পানীয়’, ‘প্লেগের চিরন্তন প্রতিষেধক’, ‘নির্ভেজাল প্লেগ ওয়াটার’…। হেনরি ফো লিখেছেন, প্লেগের ওষুধের এতরকম বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল যে, তা নিয়ে আলাদা একটা বই লেখা যায়।

বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ছিল হ্যান্ডবিল। তার একটায় লেখা ছিল, ‘হল্যান্ড থেকে এসেছেন ধন্বন্তরি চিকিৎসক। গত বছর আমস্টারডামে তিনি হাজার হাজার প্লেগ রোগীকে সারিয়ে তুলেছেন।’ একটায় বলা হয়েছিল, ‘নাপোলি থেকে এসেছেন অভিজাত মহিলা চিকিৎসক। তিনি গুপ্তবিদ্যায় পারদর্শিনী। ইতালিতে যখন প্লেগে রোজ ২০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন অনেকের জীবন বাঁচিয়েছেন।।’

অনেক প্রতারক পারদ বা ওই জাতীয় কোনও পদার্থ দিয়ে বানিয়েছিল মলম। সবাইকে বলত, সেই মলম গায়ে মেখে নিলে প্লেগ আর শরীরে ঢোকার পথ পাবে না।

একজন বড় বড় হরফে চারদিকে লিখেছিল, অমুক ডাক্তার বিনামূল্যে সবাইকে পরামর্শ দেন। সেই শুনে গরিবরা ভিড় করল তাঁর চেম্বারে। তিনি অনেক ভাল ভাল উপদেশ দিলেন। প্লেগ থেকে বাঁচতে হলে কী কী ব্যায়াম করতে হবে বললেন। শেষে বললেন, ব্যায়ামের সঙ্গে খেতে হবে একরকম ওষুধ। তাহলে প্লেগ আর ছুঁতে পারবে না। এমনকি কেউ যদি প্লেগরোগীর সংস্পর্শে থাকে, তাহলেও তার কিছু হবে না।

সেই ওষুধের এক শিশির দাম আধ ক্রাউন।

এক গরিব মহিলা বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনার যে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করার কথা ছিল!

ডাক্তার বললেন, আমার বিজ্ঞাপনটা ভাল করে পড়ে দেখ, লেখা আছে, বিনামূল্যে পরামর্শ দেওয়া হয়। ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ তো আমি বিনামূল্যেই দিলাম বাপু।

সেই মহিলা কপাল চাপড়ে বললেন, ‘হায় হায়! আগে যদি জানতাম আপনি এমন ফাঁদ পেতে রেখেছেন, তাহলে কি আসতাম। ফেরিওয়ালাও তো বিনা পয়সায় তার জিনিস কেনার পরামর্শ দিয়ে থাকে!’

লন্ডনে মহামারী চলেছিল দু’বছর। তার দাপটে শহরের এক চতুর্থাংশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

এখন বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দ্রুত ভ্যাকসিনও তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের স্বভাব বদলায়নি। ভুয়ো প্রতিষেধক নিয়ে ফলাও ব্যবসা করার জন্য আছে দেবাঞ্জন দেব ও আরও অনেকে।

জোচ্চুরির ব্যবসা করতে হলে একটা ছদ্মবেশ লাগে। সপ্তদশ শতকে প্লেগের ‘ওষুধ’ বিক্রি করার জন্য কেউ সাজত হল্যান্ড ফেরত ডাক্তার, কেউ বা ইতালির ধন্বন্তরি। অনেকে সাজত ডাইনি কিংবা কালা জাদুর কারবারি। একুশ শতকে তাদের ভেক বদলেছে। দেবাঞ্জনরা এখন সাজে আইএএস অফিসার কিংবা পুরসভার বড় কর্তা। বড় বড় নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলিয়ে সাজিয়ে রাখে। এইভাবে মানুষকে বিশ্বাস করায়, সে একজন কেউকেটা।

ডিফো চার শতাব্দী আগে লন্ডনের প্লেগের কথা লিখে গিয়েছেন। কিন্তু বইটা পড়লে এযুগের প্রতারকদেরও বেশ চেনা যায়।