পাঞ্জন গোস্বামী:
হর্ষদ মেহতা, মেহুল চোকসি, নীরব মোদি, ললিত মোদি, বিজয় মাল্যরা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সেই তুলনায় এই মানুষটির প্রতারণার অঙ্ক অত্যন্ত কম হলেও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা একেই ভারতের সর্বকালের সেরা প্রতারক আখ্যা দিয়েছেন কেবলমাত্র তার ক্ষুরধার বুদ্ধির জন্য। যার জোরে সে বেচে দিয়েছিল তাজমহল। একবার দুবার নয়, তিন তিনবার।
এই প্রতারকের বাহান্নটি ছদ্মনামের মধ্যে মিস্টার নটবরলাল নামটা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে যায়। এমনই বিখ্যাত হয়ে যায় যে নটবরলাল শব্দটা আজ হিন্দি ভাষায় প্রতারকের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঠগের জীবন নিয়েই তৈরি হয়েছিল অমিতাভ বচ্চনের সুপারহিট সিনেমা মিস্টার নটবরলাল।
” নাম মিথিলেশ শ্রীবাস্তব, উর্ফ নটবরলাল”
বিহারের সিওয়ান জেলার জিরাদাইয়ের বাঙ্গরায় ১৯১২ সালে জন্ম হয় মিথিলেশ শ্রীবাস্তবের। বাবা রঘুনাথ প্রসাদ ছিলেন রেল কর্মচারী। মেধাবী মিথিলেশ স্নাতক হয়ে আইন নিয়ে পড়াশুনা করতে করতে শুরু করে লোক ঠকানো। নিজের গ্রামের এক লোকের সঙ্গে প্রথম প্রতারণা করে। সেই ব্যক্তি নিখিলেশকে শহরের ব্যাঙ্কে ড্রাফট জমা করতে দিয়েছিলেন। জমা করার সময় ড্রাফটে ব্যক্তির সই দেখে নকল করে নেয় নিখিলেশ।
তারপর খেপে খেপে প্রায় ১০০০ টাকা অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নেয়। ১৯৩০ নাগাদ ১০০০ টাকার বর্তমান মূল্য আশা করি অনুমান করতে পারছেন। একদিন ধরা পড়ে যায় সে। বাবা পেটানোর পরে ঘর ছেড়ে নিখিলেশ পালায় কলকাতায়। এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে টিউশন পড়ানো শুরু করে কলকাতায় গিয়ে । সেখানে তুলোর ব্যবসায়ী শেঠকে সাড়ে চার লাখ টাকা ঠকিয়ে নেয়।
মিথিলেশ শ্রীবাস্তব ওরফে আসল নটবরলাল
এরপর ৬৬ বছর ধরে ভারতের আট রাজ্যে পঞ্চাশটি ছদ্মনাম ব্যবহার করে প্রায় ৪০০ লোককে ঠকিয়ে কোটি টাকা উপার্জন করেছে মিথিলেশ শ্রীবাস্তব। ছদ্মবেশ ধরায় অসম্ভব পটু ছিল নটবরলাল। প্রতারণার নিত্যনতুন আইডিয়া আবিষ্কার করত। যেমন তুখোড় ইংরেজি বলতে পারত, তেমনই ছিল তার ব্যাক্তিত্ব ও আইনের বিষয়ে অগাধ জ্ঞান। এছাড়াও মানুষদের সই হুবহু জাল করায় ছিল সে ছিল ওস্তাদ। একবার কারও সই দেখেই সেই সইটা নিঁখুতভাবে নকল করতে পারত। বেশিরভাগ লোককে সে ঠকিয়েছে তাদের সই জাল করে।
ঠকিয়েছিল টাটা বিড়লা ধীরুভাই আম্বানিদেরও
নটবরলাল সমাজসেবী বা বিশিষ্ট কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সেক্রেটারি বা কোনও বড় দলের নেতা সেজে বড় অঙ্কের চাঁদা বা ডোনেশন নিয়ে আসত টাটা বিড়লা এবং ধীরুভাই আম্বানিদের কাছ থেকে। নিখুঁত নথি ও অসামান্য বাকপটু হওয়ায় তাঁরা সন্দেহই করেননি। বহুদিন ধরে অর্থ দিয়ে গেছেন নটবরলালকে। নিজেকে সব সময় কোনও কেন্দ্রীয় স্তরের নেতা বা মন্ত্রীর সেক্রেটারি দেখাত। সেরকম সাজ পোষাক ও জাল সরকারি কাগজপত্র ও স্ট্যাম্প নিজের সঙ্গে রাখত। এসব দিয়ে দেশের বিখ্যাত বিখ্যাত স্বর্ণব্যবসায়ীদের বোকা বানিয়ে তাদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার হিরে-জহরৎ, সোনাদানা কিনে জাল চেক বা ড্রাফট দিত। তারপর তার টিকির দেখা মিলত না।
যৌবনে নটবরলাল
যখন রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নারায়ণ দত্ত তিওয়ারির সেক্রেটারি সেজে দিল্লির এক নামকরা এক ঘড়ির দোকানে যায় নটবরলাল। মালিককে বলে প্রধানমন্ত্রী ভারতে সফররত বিদেশী অতিথিদের ৯০টি দামী ঘড়ি উপহার দেবেন। সেই জন্য ঘড়ি কিনতে তাকে পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
অশোকস্তম্ভের ছাপ মারা সরকারী প্যাডে মন্ত্রীর সই করা চিঠি দেখে দোকানদার ৯০ টি ঘড়ি নিয়ে নর্থ ব্লকে অর্থমন্ত্রীর দফতরের সামনে যায়। সেখানে ঘড়ি ডেলিভারি নিয়ে সরকারি ড্রাফট দেয় প্রতারক নটবরলাল। ড্রাফট ভাঙাতে গিয়ে দোকানদার বোঝেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। ততক্ষণে পাখি হাওয়া।
ঘড়ি দোকানিকে এই ড্রাফট দিয়েছিল নটবরলাল
তিনবার তাজমহল, দুবার লালকেল্লা বেচে দিয়েছিল নটবরলাল
আইনজীবী হওয়ায় জমি জমার কাগজপত্রের খুঁটিনাটি জানত নটবরলাল। তাজমহলের মালিকানা তার, এই মর্মে প্রয়োজনীয় সব কাগজ ও সরকারী নথি জোগাড় করে সে তিনবার তাজমহল বেচে দিয়েছিল বিদেশীদের কাছে। শুধু তাজমহল নয় লালকেল্লাও বেচে দিয়েছিল দু’বার। এছাড়াও প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের সই নকল করে সরাকারি নির্দেশ জারি করে ও প্রয়োজনীয় নিঁখুত নথিপত্র দেখিয়ে বেচে দিয়েছিল লোকসভা ভবনও। পুলিশ ও আদালতের কাছে থাকা মামলার নথি দেখলে বোঝা যাবে এইসব অভিযোগ একবর্ণ মিথ্যে নয়।
কীভাবে ঠকাও লোকদের? কানপুর আদালতে জজসাহেবের মুখ থেকে এই প্রশ্ন শুনে জজের কাছ থেকে একটাকা চেয়েছিল নটবরলাল। টাকা নিয়ে পকেটে পুরে নিয়ে নটবরলাল উত্তর দিয়েছিল, “আমি লোকেদের কাছে চাই, এভাবেই লোক আমাকে দিয়ে দেয়। আমি কাউকে বন্দুক দেখিয়ে বা মারধোর করে লুঠ করিনি। দেড়শোটি মামলায় আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ বা আঘাত করার অভিযোগ নেই। আমি চেয়েছি ওরা দিয়েছে। ভারত সরকার চাইলে আমার বুদ্ধি ধার নিতে পারে। বিদেশীদের কাছে ভারতের ধার মিটিয়ে দেব আমি।” বলাইবাহুল্য, এক টাকা সে আর জজসাহেবকে ফেরত দেয়নি।
জেলের গাড়ি থেকে নেমে আদালতে যাচ্ছে নটবরলাল
এক ঘটনা, যা পরে জোকস হিসেবে সারা ভারতে ছড়িয়ে গেছে
নটবরলাল তখন লখনউ জেলে বন্দি। কয়েক মাস পর পর স্ত্রীর চিঠি আসে কিন্তু দেড় বছর ধরে সে কোনও চিঠির উত্তর দেয় না। আট নম্বর চিঠিটি নিয়ে এসে জেলার নটবরলালকে বলেছিলেন, এ চিঠির উত্তর তোমায় দিতেই হবে। নটবরের স্ত্রী চিঠিতে লিখেছেন, তিনি জমি চাষ করবেন। কিন্তু পয়সা নেই। উত্তরে নটবরলাল লিখেছিল, জমির একজায়গায় একফুট নীচে প্রচুর সোনা লুকানো আছে, সেখান থেকে কিছু নিয়ে আপাতত কাজ চালাতে। কদিন পরেই জেল থেকে বেরিয়ে ঘরে ফিরে বাকি ব্যবস্থা সে করে দেবে।
চিঠি নটবরের স্ত্রীয়ের কাছে যাওয়ার আগেই পুলিশ গ্রামে চলে গিয়েছিল সোনা উদ্ধারে। কয়েকশো লোক লাগিয়ে পুরো জমি খুঁড়ে ফেলেও সোনা মেলেনি। কয়েকমাস বাদে জেলে নটবরের স্ত্রীর চিঠি এল, তাতে লেখা পুলিশরা খেত চষে দিয়ে যাওয়ার ফলে ফসল এবার খুব ভালো হয়েছে। রাগে অগ্নিশর্মা জেলার নটবরের সেলে এসে চেঁচামেচি করতে থাকলে নটবরলাল বলেছিল, আপনি জোর করেছিলেন তাই চিঠি লিখেছিলাম। এই জন্যই স্ত্রীর চিঠির উত্তর দিতাম না।
১৯৯৬ সালে শেষবার নটবরলালকে দেখা গিয়েছিল
৬৬ বছর ধরে প্রতারণা চালিয়ে মোট ন’বার গ্রেফতার হয়েছিল নটবরলাল। জেলে মোট কাটিয়েছিল ২০ বছর। তার নামে আট রাজ্যে দেড়শোর বেশি প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মাত্র প্রথম ১৪ টি কেসের রায়েই নটবরলালের ১১৩ বছরের জেল হয়েছিল। তবে ন’বারই জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল নটবরলাল। একবার সাংবাদিকরা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে কীকরে জেল থেকে পালায়। মুচকি হেসে নটবরলাল বলেছিল, ওরা জেলের আর জেলভ্যানের দরজা খুলে আমাকে চলে যেতে বলে, আমি তখন কী করব বলুন।
১৯৯৬ সালে যখন শেষবারের মতো গ্রেফতার হয় নটবরলাল, সেই সময়ে তার বয়েস ছিল ৮৪ বছর। কানপুর জেলে চলার ক্ষমতা হারানো নটবরলালের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল হুইল চেয়ার। তাকে দিল্লির এইমস-এ ভর্তি করার নির্দেশ দেয় আদালত। কানপুর থেকে ট্রেনে করে নটবরলালকে দিল্লিতে নিয়ে এসে ট্রেন থেকে নামিয়ে আবার হুইল চেয়ারে বসানো হয়। জেল পুলিশরা রেলপুলিশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পিছন ঘুরে দেখে হুইল চেয়ার ফাঁকা। নটবরলাল উধাও। দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ২৪ জুন। সেই শেষবারের মতো তাকে দেখতে পেয়েছিল পুলিশ। তারপর আর তার টিকির সন্ধান পাওয়া যায়নি।
ভারতের সেরা ঠগ, কিন্তু নিজের গ্রাম বাঙ্গরায় ‘রবিনহুড’
আজও বাঙ্গরা গ্রামের অধিবাসীরা তাকে ভগবান মানে। তাকে শুধু ‘নটবরলাল’ বলা যাবে না। বলতে হবে ‘মিস্টার নটবরলাল’ বা ‘মিথিলেশ বাবু’। গ্রামের লোকেরা আজও বলেন, গরীবদের লুটে যারা বড়লোক হয়েছিল, তাদের লুটে মিথিলেশ বাবু সেই টাকা আবার গরীবদের ফিরিয়ে দিত। আশির দশকে তিনটি গাড়ির কনভয় নিয়ে শেষবার গ্রামে গেছিল নটবরলাল। সামিয়ানা টাঙিয়ে সারা গ্রামের জন্য বিশাল ভুরিভোজের ব্যবস্থা করেছিল। খাওয়ার পর গ্রামবাসীদের প্রত্যেককে একশো করে টাকা দিয়েছিল। পুলিশ জানতেই পারেনি।
নটবরলালের গ্রাম বাঙ্গরা
২০০৯ সালে নটবরলালের উকিল আদালতে জানান নটবরলাল জুলাই মাসের ২৫ তারিখে নটবরলাল মারা গেছে। তাই বকেয়া শতাধিক মামলা তাই খারিজ করে দেওয়া হোক। মামলা খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু নটবরলালের ভাই গঙ্গাপ্রসাদ সংবাদ মাধ্যমকে জানান দিল্লি স্টেশন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরে, ওই বছরই নটবরলাল রাঁচিতে মারা গেছে। নিজের মৃত্যুর ওপরও নিজের স্টাইলেই রহস্যের পর্দা বিছিয়ে গিয়েছিল প্রতারক নটবরলাল।
যে জিরাদাই এলাকায় নটবরলালের জন্ম, সেই এলাকাতেই জন্ম হয়েছিল ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের। ভাবতেই অবাক লাগে, এই জিরাদাই স্টেশন থেকেই ট্রেনে চড়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতিভবনে। একই স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছিল মিস্টার নটবরলালও, দেশের জনগণকে ঠকাবার জন্য। -সংগৃহীত