Home অন্যান্য নানা রকম হাতঘড়ি

নানা রকম হাতঘড়ি

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

ঘড়ির দোকানে গেলে দোকানে থরে থরে সাজানো হাত ঘড়ি (Wrist Watch) দেখে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কত শত কোম্পানির কত ধরণের এবং কত রঙের যে হাত ঘড়ি সাজানো থাকে তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের বাড়িতেও তো বিভিন্ন ধরণের কোনটা গোল কোনটা চৌকো কত আকৃতির হাত ঘড়ি রয়েছে। কিন্তু হাত ঘড়ির এই একেকটি আকৃতির যে নাম আছে আর তার পিছনে যে একটা মস্ত বড় ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে সেটা আমরা ক’জন জানি! আসুন এই সুযোগে সেগুলো জেনে নেওয়া যাক।

ঐতিহাসিকদের মতে হাত ঘড়ি পরার অর্থাৎ ঘড়িকে হাতে বাঁধার প্রয়োজনীয়তা প্রথম দেখা দেয় সৈন্যদের। কারও মতে বোয়ার যুদ্ধে প্রথম হাত ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়। আবার অন্য মতে বোয়ার যুদ্ধের আগেই জার্মান নৌবাহিনীর সৈন্যরা এমন একটা ঘড়ি দরকার যা বারবার পকেট থেকে বের করে দেখতে হয় না সেরকম একটা ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কিছু ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায় সম্রাট নেপোলিয়ন নাকি যুদ্ধের সময় বারংবার পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখতে হচ্ছিল বলে ভীষণ বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তবে সর্বসম্মত মত হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই হাতঘড়ির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে।  

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে বিশ্বের প্রথম হাতঘড়িটি তৈরি করেন সুইস ঘড়ি নির্মাতা পাটেক ফিলিপ হাঙ্গেরির কাউন্টেস কসকোউইকজের জন্য ১৮৬৮ সালে।

কিন্তু পুরুষদের জন্য কবে প্রথম হাতঘড়ি তৈরি হল সে নিয়ে কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রমাণ নেই। তবে মোটামুটিভাবে সর্বজন গ্রাহ্য মতানুযায়ী ১৮৮০ সালে জার্মান ইম্পেরিয়াল নেভির এক অফিসার বোমা বর্ষণের সময় বারংবার পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখতে অসুবিধে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে জার্মান নেভি সুইজারল্যান্ডর লা চাক্স-ডি-ফন্ডস(La Chaux-de-Fonds) এর ঘড়ি নির্মাতা জিরাার্ড-পেরেগেক্স (Girard-Perregaux)কে বার্লিনে ডেকে পাঠায় এমন ঘড়ি বানানোর জন্য যা হাতে বাঁধা যায়।

বৃত্তাকার হাত ঘড়ি (Round shaped Wrist Watch) – হাতঘড়ির জন্মলগ্নে পকেট ঘড়িকেই চামড়ার স্ট্র্যাপে বেঁধে ব্যবহার করা হত। পকেট ঘড়ি যেহেতু গোলাকৃতি হত সেহেতু গোল আকারের হাতঘড়ি প্রথম ব্যবহার হওয়া শুরু হল। গোলাকৃতি ঘড়িতে ডায়ালটি অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত হওয়ার দরুন ঘড়ির কাঁটাগুলি সহজেই স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এছাড়া ঘড়ির মধ্যে যে সব যন্ত্রাংশ থাকে সেগুলি বেশীরভাগই গোলাকার হয়। তাই দেওয়াল ঘড়ি থেকে পকেটঘড়ি সবই একসময় গোল হত।

ট্যাঙ্ক আকৃতির হাত ঘড়ি (Tank shaped Wrist Watch) – এই আকৃতির হাতঘড়ির সাথে আমরা ভীষণ পরিচিত। আয়তাকার এই হাতঘড়িগুলিকে “ট্যাঙ্ক শেপড ওয়াচ” (Tank Shaped Watch) বলা হয়। ট্যাঙ্ক আকৃতির এই হাতঘড়ি তৈরির পেছনে একটি বলার মত ইতিহাস আছে। ফরাসী-ব্রাজিলীয় বিমান চালক আলবার্তো সান্টোস-ডুমনীমা প্রথম ইউরোপীয় বিমান চালক হিসেবে ১৯০৬ সালে আকাশে বেশ কিছুক্ষণ বিমান ওড়ানোর রেকর্ড করেন। এক দিন তিনি তাঁর বন্ধু লুই কার্টিয়ারের কাছে (Louis Cartier) কাছে অভিযোগ করলেন যে আকাশে বিমান চালানোর সময় বারবার পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখতে তাঁর বেশ অসুবিধে হয়। কথাটা মাথায় গেঁথে যায় কার্টিয়ারের। এর প্রায় এগারো বছর পরে ১৯১৭ সালে কার্টিয়ার প্রথম গোলাকার হাতঘড়ির বাইরে বেরিয়ে আয়তাকার বা বলা ভালো যুদ্ধ ট্যাঙ্কের আকারের একটি ঘড়ি তৈরি করলেন বন্ধুর জন্য। আকাশ থেকে তোলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সর্বাধুনিক রেনল্ট যুদ্ধ ট্যাঙ্কের একটি ছবি খবরের কাগজে দেখে তাঁর মাথায় এই ট্যাঙ্ক আকৃতির হাত ঘড়ি তৈরির চিন্তা মাথায় আসে। যুদ্ধ ট্যাঙ্কের আয়তাকার আকৃতি ও দুপাশে থাকা চাকা চলার সমান্তরাল ট্র্যাকের অনুকরণেই এই ‘ট্যাঙ্ক’ আকৃতির ঘড়িটি তৈরি করেন তিনি। গোলাকার ঘড়ির পরেই এই ট্যাঙ্ক আকৃতির ঘড়ি পৃথিবীতে দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম হাত ঘড়ির ডিজাইন। গ্রেটা গার্বো থেকে শুরু করে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি, লেডি ডায়না পৃথিবীর তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বদের হাতে এক সময় নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি জাহির করত কার্টিয়ারের এই ট্যাঙ্ক আকৃতির ঘড়ি।

আয়তাকার হাত ঘড়ি (Rectangle shaped Wrist Watch): ফরাসী ঘড়ি নির্মাতা জেগার-লেকোল্ট্রে (Jaeger-LeCoultre) রিভার্সো'(Reverso) নামে বিশ্বের প্রথম আয়তাকার হাত ঘড়ি তৈরি করেন যেটির ডায়ালটি প্রয়োজনে কেসের মধ্যেই উল্টে রাখা যেত। এই ঘড়ি তৈরির পেছনেও একটি ইতিহাস আছে। লেকোল্ট্রে প্রধানত পোলো খেলোয়াড়দের জন্য রিভারসো তৈরি করেছিলেন। ১৯৩০-এর দশকে ভারতে থাকা ব্রিটিশ অফিসারদের এমন একটি ঘড়ির দরকার ছিল যা তীব্র গতির পোলো ম্যাচের সময় পোলো ম্যালেটের আঘাতেও অক্ষত থাকবে। ‘রিভার্সো’ তার সফলতম সমাধান হিসেবে বাজারে এল। ঘড়িটি না পুরোপুরি আয়তাকার না পুরোপুরি বর্গাকৃতি ছিল। তবে হাত ঘড়ি যে আয়তাকার থেকে এবার বর্গাকার হতে চলেছে তা কিন্তু এই ঘড়ি বেশ ভালোভাবেই জানান দিচ্ছিল।

বর্গাকার হাত ঘড়ি (Square shaped Wrist Watch): বর্গাকৃতি হাত ঘড়ির প্রকৃত জনক বলা যায় ট্যাগ হিউয়ার (TAG Heuer)কে। ১৯৬৯ সালে ট্যাগ হিউয়ারের প্রপৌত্র জ্যাক হিউয়ার বিশ্বের প্রথম বর্গাকার হাতঘড়ি ‘মোনাকো’ (Monaco) প্রকাশ করেন। মোনাকো কেবল বিশ্বের প্রথম বর্গাকার হাতঘড়িই নয়, বিশ্বের প্রথম জল নিরোধক বর্গাকার হাতঘড়ি এবং বিশ্বের তৃতীয় অটোম্যাটিক ক্রোনোগ্রাফ।

কুশন আকৃতির হাত ঘড়ি (Cushion shaped Wrist Watch): এই ধরণের হাতঘড়ি আমি আপনি সকলেই দেখেছি কিন্তু এই ডিজাইনটির নাম কি সেটা কিন্তু আমরা জানিনা। এই ডিজাইনটিকে ‘কুশন’ বলে। এই ধরণের ডিজাইন গোলাকৃতি এবং বর্গাকৃতির মিশেলে তৈরি। ১৯৪০ সালে প্যানেরাই রেডিওমির (Panerai Radiomir) কোম্পানি প্রথম এই ডিজাইনের হাতঘড়ি বাজারে আনে।

টনেউ(ব্যারেল)আকৃতির হাত ঘড়ি (Tonneau/Barrel shaped Wrist Watch): ফরাসি শব্দ ‘Tonneau’ -র বাংলা অর্থ – ‘পিপে’ ইংরেজি অর্থ ‘ব্যারেল’। এই আকৃতির ঘড়ি দেখতে অনেকটা পিপের মত হয় বলে এর নাম ‘টনেউ’। দেখতে অনেকটা তাকিয়া বা কুশন আকৃতির মত হলেও কুশন আকৃতির তুলনায় লম্বা হয়। এই টনেউ আকৃতির জন্মদাতাও লুই কার্টিয়ার। ট্যাঙ্ক আকৃতির হাত ঘড়ি আবিষ্কারের আগেই কার্টিয়ার ১৯০৬ সালে এই টনেউ আকৃতির ঘড়ি তৈরি করেন। পরবর্তীকালে ভ্যাচেরন কনস্ট্যান্টিন কোম্পানি ১৯১২ সাল থেকে কার্টিয়ারের পাশাপাশি টনেউ আকৃতির ঘড়ি তৈরি শুরু করে।

অসামঞ্জস্য আকৃতির হাত ঘড়ি (Asymmetrical shaped Wrist Watch): এই আকৃতির হাতঘড়ি প্রথম বাজারে আসে ওমেগা’র মাধ্যমে। পৃথিবী বিখ্যাত হাতঘড়ি কোম্পানি ওমেগা তাদের স্পিড মাস্টার এডিশনে প্রথম এই আকৃতির হাতঘড়ি আনে। ওমেগা স্পিড মাস্টার এডিশন আরেকটি কারণেও ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে- চাঁদের মাটিতে দাঁড়ানো নিল আমস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিনের হাতে এই ঘড়িটি ছিল। নাসার দেওয়া প্রায় এগারোটি পরীক্ষায় পাস করে ওমেগা স্পিড মাস্টার চাঁদে যাওয়ার ঐতিহাসিক অ্যাপেলো-১১ মিশনে যাওয়ার ছাড়পত্র পায়।

আভা গার্দ আকৃতির হাত ঘড়ি (Avant-Garde shaped Wrist Watch): আভা গার্দ একটি ফরাসি শব্দ যার অর্থ- নতুন ধরণের, প্রথাবিরোধী, সৃজনমূলক ভাবনা। যে সব ঘড়ি উপরিউল্লিখিত কোন আকারের মধ্যেই পড়ে না তাদের আভা গার্দ ওয়াচ বলা হয়।