কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগ এবং এর জের ধরে চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে কোনো পক্ষ যেন অস্থিরতা তৈরি করতে না পারে তার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। কুমিল্লার ঘটনার পরপরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে সংসদীয় কমিটি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কুমিল্লার ঘটনার পর গত বুধবার রাতেই দেশের মন্দিরগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনা তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকার মন্দিরের নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্যও বলেছেন বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা নিশ্চিত করেছেন।
কুমিল্লার ঘটনায় দোষীদের যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন করতে কেউ সাহস না পায়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গতকাল বৃহস্পতিবার মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি আয়োজিত শারদীয় দুর্গাপূজার মহানবমীর অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন সরকার প্রধান।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে সে ঘটনায় আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিলাম। এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যেখানে যেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে সেখানেই তাদের খুঁজে বের করা হবে। আমরা অতীতেও করেছি এবং আমরা সেটা করতেও পারব। যথাযথ শাস্তি তাদের দিতে হবে। এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন করতে কেউ সাহস না পায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা সবাই ভালো থাকেন সেটা আমরা চাই। আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। আওয়ামী লীগ সৃষ্টি হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘আমি আপনাদের আবারও অনুরোধ করব, আপনারা কখনোই নিজেদের সংখ্যালঘু ভাববেন না। আমরা আপনাদের সংখ্যালঘু না, আমরা আপনাদের আপনজন হিসেবে মানি। আপনাদের এ দেশের নাগরিক হিসেবে মানি। সমন্ডঅধিকারে আপনারা বসবাস করেন। আপনারা সমন্ডঅধিকার ভোগ করবেন। সমন্ডঅধিকার নিয়ে আপনাদের ধর্ম পালন করবেন, উৎসব পালন করবেন সেটাই আমরা চাই।’
কুমিল্লার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘এ ঘটনায় কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাটির তদন্ত হচ্ছে। তারা মনে করছেন, স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্যমূলক কাজ এটি।’
এদিকে কুমিল্লার ঘটনা নিয়ে গতকাল সকালে একটি বিশেষ বৈঠক হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ উসকানি দিলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যারা এসব অপচেষ্টা করছে ও করবে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। এসব ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত করা হয়েছে।’
তবে এ ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। কিন্তু সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চক্রান্ত করছে। কুমিল্লার ঘটনা তারই প্রমাণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার ক্ষেত্রে দেশে একটা স্থিতিশীল অবস্থা রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যে দুর্গাপূজা হচ্ছে, সেই দুর্গাপূজায় কতগুলো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে বিশেষ করে কুমিল্লায় ও চাঁদপুরে। চাঁদপুরে তিনজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন এবং নির্বিচারে গুলি করেছে। এটা এ সরকারের চক্রান্ত। তারা এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়, ধ্বংস করতে চায় এবং দেশে স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায়। জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নিতে চায়।’
কুমিল্লার ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘অতীতে যারা পদ্মা সেতু নিয়ে নানা ধরনের গুজব রটিয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশ ও মানুষের কল্যাণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, সেই একই মহল এবারের ঘটনা ঘটিয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গতকাল পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা চলে গেলেও তাদের প্রেতাত্মারা পঞ্চগড়সহ সারা দেশেই রয়ে গেছে। তারাই আজ কারণে-অকারণে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার চেষ্টা করছে।’
কুমিল্লার ঘটনা টেনে তিনি বলেন, ‘কোন পাগলে বলবে যে কোরআন শরিফ দিয়ে হিন্দুরা তাদের পূজা করে। তাদের সঙ্গে আমাদের কোরআনের কী সম্পর্ক। তারা তাদের ধর্ম পালন করছে। সবার অলক্ষ্যে হঠাৎ করে লুকিয়ে রেখে এসে তারা বলে দিল কোরআনের অবমাননা চলছে ওই মন্দিরে। তারা তাদের ধর্ম পালন করছে। তারা সেখানে কোরআন রাখবে কেন?
-দেশ রূপান্তর