আলু চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার আশংকা
রেজাউল করিম, রংপুর: উত্তরের ১৬ জেলায় সারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চাষিদের অভিযোগ, সংকট তৈরি করে ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে আলু চাষের জন্য প্রয়োজনীয় টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের দাম। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বস্তাপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করছে বিক্রেতারা। মৌসুমের শুরুতেই সারের দামে নৈরাজ্য শুরু হলেও এখন পর্যন্ত জেলা অথবা উপজেলা সার মনিটরিং কমিটি কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
চাষিরা বলছেন, সব ধরনের সারের পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকলেও ডিলার ও খুচরা কারবারিরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছে। অন্যদিকে সার উত্তোলন ও চলাচলের বিষয়ে কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। যাদের ওপর মনিটরিংয়ের দায়িত্ব রয়েছে তারাও এ কারসাজির সঙ্গে জড়িত।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিলার ও খুচরা কারবারিদের গভীর যোগাযোগ রয়েছে। কোন ডিলার তার নামে বরাদ্দ করা সার উত্তোলন করে গুদামে রেখে বিক্রি করছে তা মনিটরিং কমিটি দেখছে না। এতে এক এলাকার সার অন্য এলাকায় অবাধে চলে যাচ্ছে। তাদের অভিযোগ, এ অঞ্চলের জন্য বরাদ্দকৃত সার তুলে কতিপয় ডিলার যশোরের নওয়াপাড়া মোকামেই বিক্রি করে দিয়ে আসছে। ওইসব সার চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের গুদামে। এসব সার অবৈধ লাইনে চলে যাচ্ছে অন্য জেলার মজুত কারবারিদের কাছে। এর ফলে রংপুরসহ উত্তরের জেলাগুলোতে সারের সংকট তীব্র হয়েছে। কালিগঞ্জের শিয়াল খোওয়ার আলু চাষি মিরাজুল ইসলাম, সদরের হরাটির সফিউল আলম ও আদিতমারির কমলাবাড়ির আজিজুলের অভিযোগ, দেশের যেসব জেলায় সবচেয়ে বেশি আলু চাষ হয় রংপুর বিভাগ তার মধ্যে অন্যতম। দুই সপ্তাহ আগে রংপুর অঞ্চলের জেলাগুলোতে আগাম আলু আবাদ শুরু হয়েছে। এখন মাঠে মাঠে জমি তৈরিতে ব্যস্ত চাষিরা।
চাষিরা জানান, আলুর জমি তৈরির সময়েই পর্যাপ্ত পরিমাণ টিএসপি, ডিওপি ও এমওপি সারের প্রয়োজন। কিন্তু চাষিরা সার পাচ্ছেন না ডিলারদের দোকানে। আবার অনুমোদিত নয়, এমন অবৈধ সার বিক্রেতাদের দোকানে সরকারি সার বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
মহিপুরের আলু চাষি শরিফুল ইসলাম বলেন, চাষি পর্যায়ে প্রতিকেজি ২২ টাকা হিসাবে ৫০ কেজির এক বস্তা টিএসপির দাম ১ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা এসব সার চাষিদের কাছে বিক্রি করছে ১ হাজার ২৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা করে। প্রতিকেজি এমওপির দাম ১৫ টাকা হিসাবে ৫০ কেজির এক বস্তার দাম ৭৫০ টাকা। কিন্তু রংপুর বিভাগের ৫৮ উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা দরে। একইভাবে ১৬ টাকা প্রতিকেজির ডিএপির ৫০ কেজির বস্তার বিক্রি মূল্য ৮০০ টাকা হলেও চাষিরা কিনছেন ১ হাজার টাকা থেকে হাজার ৫০ টাকা করে। আর চাষিরা ডিলারদের দোকানে গিয়ে কোনো সার পাচ্ছে না। তাদেরকে খুচরা দোকানে যেতে বলা হচ্ছে। এভাবেই এ অঞ্চলের জেলাগুলোতে সার বিক্রিতে নৈরাজ্য চালাচ্ছে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি অক্টোবর থেকে রংপুর কৃষি অঞ্চলে আগাম আলু আবাদ মৌসুম শুরু হয়েছে। এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৯৩ হেক্টর। এর পরিমাণ জমি থেকে সাড়ে ৪০ লাখ টন আলু ফলনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। শুধু আলু আবাদকে সফল করতে বিএডিসির ৪৭১ জন ডিলারের জন্য ৭২ হাজার ৬৭৩ টন বিভিন্ন ধরনের নন-ইউরিয়া সার বরাদ্দ করেছে। একইসঙ্গে বিসিসিআইসি তাদের ৩৪১ জন ডিলারের বিপরীতে ৩৫৪৫ টন টিএসপি, ৭৭১৩ টন এমওপি, ৯৮৫১ টন ডিএপি বরাদ্দ দিয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ সার বরাদ্দের পরও সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছে কতিপয় ডিলার ও খুচরা বিক্রেতা। আবার অনেকে ডিলার নওয়াপাড়া মোকামেই তাদের বরাদ্দ সার বিক্রি করে দিচ্ছে। এলাকায় সার না এনেও তারা কৃষি কর্মকর্তাকে টাকা দিয়ে আগাম চালানে সই করিয়ে নিচ্ছেন। এসব অভিযোগ অধিকাংশ আলু চাষির।
কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কৃষকদের কাছ থেকে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রংপুর সার ডিলার সমিতির (বিএফএ) সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, সমিতিভুক্ত সব ডিলারকেই কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোথাও যেন এক টাকা বেশি না নেওয়া হয়। তবে খুচরা ডিলাররা তাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। যদি কোনো বিক্রেতা সারের দাম বেশি আদায় করে প্রশাসন যেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন।
রংপুর কৃষি অঞ্চলে সারের সংকট ও দাম প্রসঙ্গে সার বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক তৌহিদুল ইকবাল বলেন, আলু চাষিরা জমিতে টিএসপি সারটাই বেশি দিতে চায়। যদিও টিএসপির বরাদ্দ কিছুটা কম। ইতোমধ্যে উপজেলা মনিটরিং কমিটিকে মাঠ পর্যায়ে আরও বেশি তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ বেশি দামে সার বিক্রি করছে প্রমাণ পেলে ডিলারশিপ বাতিলসহ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।