কুমিল্লা জেলা শহরের পাশে ২০০০ সালে ২৬৭ একর জমির ওপর স্থাপিত হয় কুমিল্লা ইপিজেড। সেখানে বর্তমানে ৪৮টি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ টি বিদেশি, ১৩টি যৌথ ও ৮টি দেশি মালিকানার কোম্পানি। তবে এখন সাতটি কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ। বাকি ৪১ টির মধ্যে ৩৭ টিই পোশাক ও পোশাক সংশ্লিষ্ট কারখানা। চারটি কারখানায় বৈচিত্র্যময় রপ্তানিপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। করোনার ধাক্কা সামলে বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনে এখন সরগরম এই ইপিজেড। সব মিলিয়ে এখানে বর্তমানে ৪০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন।
ইপিজেডে সরেজমিন দেখা গেছে, কারখানাগুলোয় শ্রমিকেরা প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে কাজ করছেন, মেশিনের চাকা পূর্ণোদ্যম ঘুরছে। ফলে বৈচিত্র্যময়, ব্যতিক্রমী ও বাহারি সব পণ্য উৎপাদনে সরগরম হয়ে উঠেছে কুমিল্লা ইপিজেড। ইপিজেড ও কয়েকটি কারখানার কর্মকর্তারা জানান, করোনার কারণে ইপিজেডে অনেক দিন কারখানাগুলো বন্ধ রাখার পর সবাই আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
বাচ্চাদের খাবার প্লেট, মগ, পানির বোতল, শোপিস ও নানা ধরনের পুতুল বানায় হাসি টাইগার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে হাসি টাইগার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি সাধারণত প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ ডলারের পুতুল রপ্তানি করে থাকে। তবে করোনার কারণে গত এক বছরে রপ্তানি কমে ১০ লাখ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। তবে সুখবর হলো, দুই-তিন মাস ধরে আবার ক্রয়াদেশ বাড়ছে।
প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিন দেখা গেছে, চারতলা ভবনের প্রতিটি তলায় নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা পুর্ণোদ্যমে কাজ করছেন। কাজের পরিবেশও বেশ ছিমছাম। মেশিনেও খুব বেশি শব্দ হয় না। এক তলায় ডাইস থেকে প্লাস্টিকের পুতুলের অবয়ব বানানো হয়। অন্য ইউনিট জোড়া লাগায়। আরেক তলায় চলে রঙের কাজ। প্যাকেজিং করা হয় আরেক জায়গায়। এই কারখানায় সব মিলিয়ে দেড় শর মতো শ্রমিক কাজ করেন।
হাসি টাইগারের ব্যবস্থাপক নুরুল আমিন বলেন, বছরের দ্বিতীয়ার্ধে জাপানে পুতুলের চাহিদা কম থাকে। কিন্তু এবারে অবশ্য চাহিদা বেশ। আশা করি, আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রতি মাসে আগের মতো দুই লাখ ডলারের পুতুল রপ্তানি করতে পারব। তিনি জানান, হাসি টাইগারের তৈরি খেলনার ৮০ শতাংশই জাপানে রপ্তানি হয়। বাকি ২০ শতাংশ কোরিয়া ও তাইওয়ানে যায়।
এছাড়াও কুমিল্লার ইপিজেডে ক্যামেরার জন্য বিশ্বখ্যাত নাইকন ও প্যানাসনিক দুটি কোম্পানি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ হয় কুমিল্লার জেবি নেটওয়ার্কস নামে একটি কারখানায়। শুধু নাইকন ও প্যানাসনিক ক্যামেরায় নয় ক্যামেরার বেল্ট এবং ল্যান্স রাখার ব্যাগও তৈরি হয় এই ইপিজেড থেকে।
মোটাদাগে বলা চলে, ফটোগ্রাফার তথা চিত্রগ্রাহকের গলায় যে বেল্টের সাহায্যে ক্যামেরা ঝুলে থাকে, সেটি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এই কারখানায় সুতা থেকে বুননসহ ক্যামেরার বেল্ট তৈরির সব কাজই হয় যন্ত্রের সাহায্যে। একই সঙ্গে কারখানাটিতে ক্যামেরার ব্যাগ আর লেন্স রাখার ব্যাগও বানায় জাপানের এই কোম্পানি।
সরেজমিন দেখা গেছে, কোম্পানিটির তিনতলা কারখানা বেশ পরিপাটি। প্রতিটি তলায় একেকটি পণ্যের ইউনিট। এই কারখানায় প্রায় ৬০০ কর্মী কাজ করেন। জানা গেছে, কারখানাটিতে প্রতিদিন গড়ে ক্যামেরার তিন হাজার বেল্ট বানানোর সক্ষমতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বছরে ১৪-১৫ লাখ ডলারের বেল্ট রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক বলেন, করোনার ধাক্কা সামাল দেওয়া গেছে। এখন আবার আগের মতো ক্রয়াদেশ আসছে। সব মেশিন পুরোদমে চলছে। আবার এই ইপিজেডেই চীনা সৌন্দর্য সচেতন নারীদের ব্যবহার্য চিরুনি, ক্লিপ, রিবন, ফিতা এসব বানানো হয় এখানকার আরেকটি কারখানায়।
কুমিল্লা ইপিজেডের কারখানাগুলো থেকে যত পণ্য রপ্তানি হয়, তার ৯৫ শতাংশ তৈরি পোশাক। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে এখান থেকে ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ৮৮ টাকা ধরে)। এর আগের বছর রপ্তানি হয়েছিল ৫৬ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ এক বছরে রপ্তানি ১৯ কোটি ডলার বা ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে বেশি পোশাক রপ্তানি হয়।
-বাসস