আকাশ ঘোষ
কলকাতা: ‘তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক, মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি, পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি…’ রবি ঠাকুর ‘জুতো আবিষ্কার’ কবিতায় এভাবেই ‘ভিস্তি’দের বর্ণনা করেছিলেন। তৎকালীন কলকাতা শহরের অলিগলিতে সকাল-বিকেল কাঁধে কালো চামড়ার ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তেন একদল মানুষ। হাঁক দিতেন, ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’। আর সেই ডাক শুনেই বাসিন্দারা বুঝতে পারতেন তাঁদের জন্য পানীয় জল নিয়ে হাজির হয়েছেন ‘ভিস্তিওয়ালা’।
এখন কলকাতা শহরে আর সেই ডাক শোনা যায় না বটে, তবে কিছু ‘ভিস্তিওয়ালা’ আজও আছেন মধ্য কলকাতার বুকে। বাঁধা বাড়িতে চামড়ার থলিতে করে জল পৌঁছে দেন তাঁরা। কলকাতার রিপন স্ট্রিট, রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড, ইলিয়ট রোড, মারকুইস স্ট্রিট সহ কিছু এলাকার বাড়িতে বাড়িতে বা দোকানে দোকানে জল সরবরাহ করেন তাঁরা।
আগে যেখানে বহু মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এখন তা এসে দাঁড়িয়েছে জনা কুড়ির মতো। অধিকাংশই বংশ পরম্পরায় করে আসা এই কাজ থেকে অব্যহতি নিচ্ছেন। আর তাঁদের পরের প্রজন্ম? ভিস্তিওয়ালেদের কথায়, কী পড়ে আছে আর এই ব্যবসায়? চাহিদাও নেই, তাই নতুন প্রজন্মের কেউই এই কাজে আসতে চায় না।
এখনও এই কাজকে বাঁচিয়ে রাখা এই কয়েকজন সকাল-বিকেল ছাগলের চামড়ার এক বিশেষ ধরণের থলি, যাকে মশক বলে, তাতে করেই জল পৌঁছে দেন। তবে আধুনিকতার যুগেও এখনও কেউ কেউ এই ভিস্তিওয়ালাদের থেকেই জল নেন। তেমনই রিপন স্ট্রিটের এক মাংসের দোকানের মালিক মহম্মদ আমন জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখতাম এইভাবে বাড়িতে জল পৌঁছে দিতেন ভিস্তিওয়ালারা। এখনও দোকানের জন্য জল নিই।’
শুধু দোকান নয়, ওই এলাকার এক বহুতলের ওপরের তলাতেই পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। পানীয় জলের ব্যবস্থা ঠিক না থাকায় সবসময় জল বয়ে তোলা সম্ভব হয় না। তাই এই এদের থেকে জল নিই’, বলেন তিনি। রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের বাসিন্দা মনিরুল রহমান জানালেন, ‘দোকানের কাজের জন্যই ভিস্তিওয়ালেদের থেকে জল কিনি।’
ভিস্তিওয়ালাদের এক একটা মশকে ২৫ লিটার জল ধরে। প্ৰয়োজন মতো সেই জল পৌঁছে দেওয়া হয় বাড়ি বা দোকানে। তারজন্য খরচ ১০-২০ টাকা। রাস্তার পুরসভার কল থেকে কিংবা টিউবিউল থেকে জল সংগ্ৰহ করে তা দুয়ারে পৌঁছে দেন ভিস্তিওয়ালারা।
এই এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন ভিস্তিওয়ালারা। একসঙ্গে দশ-কুড়ি জন করে বসবাস করেন। আগে সবাই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন অধিকাংশই সেই কাজ ছেড়ে অন্য কাজ করেন। আর তাঁদের মধ্যেই দু’একজন এখনও মশক ভরে জল সরবরাহের কাজ করেন।
এক-একজন ভিস্তিওয়ালা এখনও খান কুড়ি বাড়ি বা দোকানে সকাল-বিকেল মিলিয়ে জল পৌঁছে দিয়ে থাকেন। তাঁদেরই মধ্যে একজন আমিন শেখ টিউবওয়েল থেকে জল ভরতে ভরতে বললেন, ‘বাবা-ঠাকুর্দা এই কাজ করতেন আমিও করছি। তবে এরপরে আর কেউ করার মত নেই।’
ভবিষ্যতে তাহলে কী কলকাতা থেকে হারিয়ে যাবে ‘ভিস্তি’? মহম্মদ সিরাজ নামে এক ভিস্তিওয়ালা হেসে বললেন, ‘কী লাভ এই কাজ করে? পয়সা কোথায়?’
পাইপ দিয়ে ঘরে ঘরে জল পৌঁছে যাওয়ায় আজকের দিনে ভিস্তিওয়ালাদেরকেও অন্য পেশা বেছে নিতে হয়েছে। তেমনই একজন আব্দুল হামিদ। মাস তিনেক আগেও মশকে করে বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছে দিতেন তিনি। হামিদ এখনও জল পৌঁছে দেন কিন্তু প্লাস্টিকের ড্রামে করে। কেন? তাঁর কথায়, ‘ভাল মশক পাচ্ছি না, আর এখন অনেকেই এইভাবে জল নিচ্ছে না তাই ছেড়ে দিয়েছি।’ এরপরই তিনি যোগ করেন, ‘ভাল মশকের দাম বেশি। তাই তা কিনতে পারিনি। এখন এই আড়াইশ টাকার ড্রামে কাজ হয়ে যায়।’
এঁদের অধিকাংশ ভিস্তিওয়ালাদেরই আদি বাড়ি বিহারে। পরিবার ওখানে থাকলেও বাপ-ঠাকুর্দার পেশা বেছে নিয়েই মধ্য কলকাতায় ভাড়া বাড়িতেই বাস করেন তাঁরা। সকালে উঠে জল ভরে পৌঁছে দেওয়া, ৯-১০টার মধ্যে বাড়ি এসে রান্না-বান্না করে খাওয়া-দাওয়া। তারপর জিরিয়ে আবার তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়া মশক কাঁধে। এভাবেই আজও কলকাতার বুকে টিমটিম করে বেঁচে আছেন ভিস্তিওয়ালারা।