Home Second Lead নকল সনদে বিদেশি জাহাজে চাকরি

নকল সনদে বিদেশি জাহাজে চাকরি

বাংলাদেশ কালোতালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা

 

সাইফ বাবলু: নকল সনদ দিয়ে বিদেশি জাহাজে নাবিকের চাকরি পাইয়ে দেয়ার একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডি। যে প্রতিষ্ঠান এই নকল সনদ দিত তা নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরেরই অনুমোদিত। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওই প্রতিষ্ঠানের পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে সিআইডি বলছে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এরকম নকল সনদ তৈরির সঙ্গে যুক্ত বলে তাদের ধারণা। আর এর নেপথ্যে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতা রয়েছে বলেও তাদের ধারণা।

গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে বেশ কিছু জাল সার্টিফিকেট উদ্ধার করা হয়েছে। যেসব সার্টিফিকেট দেয়ার একমাত্র কর্তৃপক্ষ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যে মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ড হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় সিআইডি। সেই তথ্যের ভিত্তিতে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নকল সার্টিফিকেট বাণিজ্য খুঁজছে সিআইডি।

ইতোমধ্যে শতাধিক নাবিক নকল সার্টিফিকেট দিয়ে বিদেশি জাহাজে চাকরি করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এই নকল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি নেয়ার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে মেরিটাইমে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে বলছেন তারা।

অভ্যন্তরীণ জাহাজের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন বেসরকারি জাহাজ কোম্পানি কর্মকর্তা ও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বাংলাদেশি নাবিকদের নিয়োগ দেয়। মার্চেন্ট শিপে চাকরি নিতে হলে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদিত বেসরকারি প্রশিক্ষণ সেন্টারে নাবিকদের সার্টিফিকেট অব প্রফেসিয়েন্সি (সিওপি) এবং সার্টিফিকেট অব কম্পিটেন্সি (সিওসি) কোর্স করতে হয়। এরপর নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরে লিখিত পরীক্ষা দেয়ার পর তারা সনদ পান। অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দিয়ে বাংলাদেশি নাবিকরা দেশি-বিদেশি জাহাজে উঁচু বেতনে চাকরি পান।

সম্প্রতি নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের আদলে হুবহু একটি নকল ওয়েবসাইট তৈরি করে একটি চক্র। সেই ওয়েবসাইটের ডাটাবেজে নকল সার্টিফিকেট আপলোড করা থাকত। একটি সার্টিফিকেট নিয়ে সন্দেহ হলে একটি বিদেশি জাহাজ কোম্পানি তা পরখ করতে চায়। নকল ওয়েবসাইটে সার্টিফিকেট দেখা গেলেও মূল ওয়েবসাইটে সেটির কোন অস্তিত্ব ছিল না। বিষয়টি নৌ-অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নজরে আসলে তিনি অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি সিআইডিকেও এ বিষয়ে তদন্ত করার অনুরোধ করেন।

সিআইডির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদিত একটি প্রশিক্ষণ সেন্টারই এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সিআইডির সাইবার পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাহমুদুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বে অভিযানে রাজধানীর উত্তরখানে অবস্থিত ওরিয়েন্টাল গ্লোবাল ইন্টারন্যাশাল মেরিটাইম একাডেমির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সিরাজুল আজাদ, ডিরেক্টর মঞ্জুরুল আজাদ ও তারিকুল আজাদ, আইটি অফিসার মো. রাশেদুল ইসলাম এবং সাবেক আইটি অফিসার মোহাম্মদ সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে জিডিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে সিআইডি।

নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের নিবন্ধিত প্রশিক্ষণ সেন্টার ওরিয়েন্টাল গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমি (ওসিআইএমএ) নামে ওই প্রশিক্ষণ সেন্টারের সবগুলো সনদ ইতোমধ্যে বাতিল করেছে নৌ-অধিদপ্তর। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে তার নিবন্ধন বাতিলের জন্য নৌমন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরর মহাপরিচালক কমোডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান জানান, অভিযানে ওরিয়েন্টার গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমির দপ্তর থেকে শতাধিক নকল সার্টিফিকেট উদ্ধার করে সিআইডি। যেগুলো দিয়ে ইতোমধ্যে বিদেশি জাহাজে কর্মরত আছে বাংলাদেশি নাবিকরা।

‘এ রকম অন্যন্য বেসরকারি বা সরকারি প্রশিক্ষণ সেন্টার থেকে নকল সার্টিফিকেট যে নাবিকদের দেয়া হয়নি সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কোন কিছু বলা যাচ্ছে না,’ বলেন অতিরিক্ত ডিআইজি।

তিনি বলেন ওই চক্রকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে তারা জানতে পেরেছেন নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরর থেকেও কিছু নকল সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে নাবিকদের যা দিয়ে তারা বিদেশি জাহাজে চাকরি করছে।

সিআইডি মনে করছে, নকল সার্টিফিকেট তৈরির সঙ্গে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে। এ সিন্ডিকেটের একটি অংশ খোদ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী হতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্তে নেমেছে সিআইডির সাইবার পুলিশ বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিকদের যোগ্যতা সনদ, পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালনা এবং বিভিন্ন সার্টিফিকেট ইস্যু করার একমাত্র প্রতিষ্ঠান নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। নে-পরিবহন অধিদপ্তরে লিখিতভাবে পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পর সার্টিফিকেট অব প্রফিসিয়েন্সি (সিওপি) এবং সার্টিফিকেট অব কম্পিটেন্সি (সিওসি) দেয়া হয় । যদিও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পরীক্ষার্থীকে সব ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক জাহাজে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও ইঞ্জিনিয়ারদের যে সার্টিফিকেট রয়েছে তা প্রকৃত সার্টিফিকেট হলে সেটি যাচাই করার সুযোগ আছে। প্রত্যেকটি সার্টিফিকেট বারকোড দেয়া থাকে এবং সার্টিফিকেট নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে থাকে।

সিআইডি জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি জাহাজে নাবিক হিসেবে চাকরি করতে প্রফিসিয়েন্সি এবং কম্পিটেন্সি নামে দুটি কোর্সে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সরকারি-বেসরকারিভাবে ১০ প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার অনুমোদন রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, বাংলাদেশ মেরিন ফিসারিজ একাডেমি, ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ মেরিটাইম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ম্যাস মেরিটাইম একাডেমি, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমি, ওশিয়ান মেরিটাইম একাডেমি, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম টেনিং একাডেমি, ওয়েস্টান মেরিটাইম একাডেমি এবং ওরিয়েন্টাল গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমি।

অভিযুক্ত ওরিয়েন্টাল গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমি প্রত্যেকটি সার্টিফিকেটের বিনিময়ে নাবিকদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিয়েছে। সিআইডি জানিয়েছে, তাদের অনুসন্ধানে কিছু তথ্য মিলেছে যে নকল সার্টিফিকেট নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর থেকেও দেয়া হয়েছে। এখন বিষয়টি নিয়ে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর কাজ করবে। তারা যদি সহযোগিতা করে তাহলে তদন্ত এগুবে।

সিআইডি বলছে, মো. হযরত আলী নামে এক ব্যক্তি নকল প্রফিসিয়েন্সি সদন দিয়ে নাবিকের চাকরি করছে। ওই ব্যক্তি ম্যাস মেরিটাইম একাডেমি থেকে সিওফি কোর্স করেছে ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত। তার সার্টিফিকেট নম্বর হচ্ছে ০৪৩১৩৩৪১৬। ২০২১ সালে ৬ জুন তার সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু ওই সার্টিফিকেট নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের নয়।

একটি বেসরকারি বিদেশি জাহাজে কর্মরত একজন থার্ড ইঞ্জিনিয়ার বলেন, তিনি লিখিতভাবে পরীক্ষা দিয়ে সিওপি এবং সিওসি অর্জন করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে নকল সিওসি এবং সিওপি দিয়ে অনেকেই চাকরি করছেন বিদেশি জাহাজে। এতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা এবং ইঞ্জিনিয়ারদের নানা রকম বিপদে পড়তে হচ্ছে। এসব অপকর্ম বন্ধ না হলে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম খাতে বাংলাদেশ কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে যেকোন সময়।

ওই ব্যক্তি জানান, ২০১২-১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম একাডেমি (আইআাইএমটিএ) নামের একটি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান সিওপি এবং সিওসি নকল করেছিল। পরে সেই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে লাইসেন্স বাতিল করেছিল নৌ-মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিষ্ঠান নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমি নামে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।