Home First Lead আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্য

আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্য

ইমরান সিদ্দিকী

আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা নেদারল্যান্ডসের জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আলুর জাত কৃষকরা চাষাবাদ শুরু করেন। দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত তিন মাসে ফলন হয় এমন আলুর জাত উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু ফলে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলে। এ বিষয়ে কৃষি সচিব সায়েদুল ইসলাম বলেন, দেশে আলু উৎপাদন এক কোটি টন ছাড়িয়েছে। কয়েক বছর ধরেই ৪ লাখ ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আলুর আবাদ হচ্ছে। আলু আবাদে প্রায় আট লাখ টন বীজের প্রয়োজন। বীজের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই এখন দেশে উৎপাদন হচ্ছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের ১১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের আলু

আলু উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্যই কেবল নয়, আলু এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসলও। মাধ্যম হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশের খাদ্যশক্তির দ্বিতীয় প্রধান উৎস আলু। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি করে আলু খায়- যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। আলু খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে উলেস্নখ করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলু বাংলাদেশের মানুষের ভিটামিন ও কার্বোহাইড্রেটের চাহিদার অনেকাংশ পূরণ করছে।

মহামারি করোনাকালে ধানের মতো এক ধাপ এগিয়েছে আলুর উৎপাদন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ আলুর উৎপাদন বিষয়ক পরিসংখ্যান বলছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে ষষ্ঠ বাংলাদেশ। ২০২১ সালে বিশ্বে আলু উৎপাদনে ছিল সপ্তম। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ।

গত এক যুগে দেশে আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য যেমন চিপস, ফ্লেক্স, অন্যান্য খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্যাটালিস্টের হিসাবে দেশে অন্তত ৩৭টি আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছ। এর মধ্যে আটটি কোম্পানি আলু থেকে উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিদেশেও রপ্তানি করছে। অথচ এক সময় শীতকালে মুন্সীগঞ্জসহ দেশের কয়েকটি জেলায় আলুর চাষ হতো। আলু গরিবের খাবার হিসেবে পরিচিত। সেই দিন বদলে গেছে, দেশে আলুর ফলন এখন এক কোটি ১০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে নীরবে আলুর বিপস্নব ঘটে গেছে। ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য ও খাদ্যশক্তির উৎস হচ্ছে আলু। গত চার যুগে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ২৭ গুণ। আর মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। দেশের উত্তরাঞ্চল রংপুর একসময় মঙ্গাপীড়িত বলে পরিচিত ছিল। সেখানে এখন উৎপাদিত হয় বছরে ৩০ লাখ টন আলু।

গত একযুগে দেশে আলুর ফলন বেড়েছে বহুগুণ। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আলু ভর্তার গন্ডি থেকে বেরিয়ে এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিপস হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে আলু। রপ্তানি খাতেও সুনাম বয়ে আনছে আলু। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে বছরে আলুর ফলন কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। মূলত ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে আলু উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। ইউরোপে যেখানে আলুর সঠিক ফলন পেতে পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে, সেখানে বাংলাদেশে আলু পেতে তিন মাস লাগে। এখানকার মাটি, পানি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যাওয়ায় আলুর উৎপাদন সময়কাল কমেছে।

গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীরা প্রায় ৭০টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) আলুর নতুন জাত উদ্ভাবনে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশর বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশের আলুর আদিজাত হচ্ছে মিষ্টি আলু। আর গোল আলুর আদিজাত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। পরবর্তী সময়ে তা পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও নাবিকদের হাত ধরে ইউরোপে আলুর চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০০ বছর আগে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলায় আলুর আবাদ শুরু হয়।

আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা নেদারল্যান্ডসের জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আলুর জাত কৃষকরা চাষাবাদ শুরু করেন। দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত তিন মাসে ফলন হয় এমন আলুর জাত উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু ফলে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলে।

ছবি সংগৃহীত

এ বিষয়ে কৃষি সচিব সায়েদুল ইসলাম বলেন, দেশে আলু উৎপাদন এক কোটি টন ছাড়িয়েছে। কয়েক বছর ধরেই ৪ লাখ ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আলুর আবাদ হচ্ছে। আলু আবাদে প্রায় আট লাখ টন বীজের প্রয়োজন। বীজের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই এখন দেশে উৎপাদন হচ্ছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের ১১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে

বাংলাদেশের আলু। আলুর বার্ষিক অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টনের মতো। সে হিসাবে দেশে প্রায় ৪০ লাখ টন আলু অতিরিক্ত থাকছে। রপ্তানি উপযোগী আলু উৎপাদনে উন্নতমানের বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ থেকে স্থায়ীভাবে বৃহৎ পরিসরে আলু রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, খাবার তালিকায় ভাতের পরেই আলুর অবস্থান। আলু বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্যশস্য- যার পূর্বে রয়েছে ভুট্টা, গম ও চাল। ফলে আলুর চাহিদাও বাড়ছে। রপ্তানি ও শিল্পে ব্যবহারযোগ্য এবং আগাম জাতের আলুর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। শিল্পে ব্যবহারযোগ্য আলুর চাষ বাড়াতে কাজ করছে সরকার। এছাড়া বিদেশে আগাম জাতের আলুর চাহিদা থাকায় তা উৎপাদন ও রপ্তানির পরিকল্পনা করছে সরকার। উন্নত আলুর জাত কৃষকে দোরগোড়ায় পৌঁছালে একদিকে তারা লাভবান হবেন, অন্যদিকে আয় হবে বৈদেশিক মুদ্রাও। তিনি আরো বলেন, বিদেশ থেকে উচ্চফলনশীল, শুষ্ক পদার্থের উপস্থিত সম্পন্ন রপ্তানি ও শিল্পে ব্যবহারযোগ্য এসব আলুর জাত চাষের ফলে আলু রপ্তানির অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আলুর বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ আলু রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিইএ) তথ্য মতে মালয়েশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোতে এই আলুর বিশেষ চাহিদা বিদ্যমান। সেসব দেশে আলু রপ্তানি হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে এ বছর চার লাখ আশি হাজার হেক্টর জমিতে ১১ মিলিয়ন টন আলু উৎপাদিত হয়।