ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী তথা জাতীয় কংগ্রেস দলের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুপ্ত হত্যা বা খুনের ইতিহাস কম নেই। তেমনই এক ঘনীভূত রহস্য জড়িয়ে আছে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মৃত্যুকে ঘিরেও। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনিই ভারতের প্রধানমন্ত্রী। যুদ্ধ চাননি তিনিও, তাই দুই বাহিনীই যখন সন্ধি করতে রাজি হয় নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে তাসখন্দে যান লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আর সেখানেই ঘটে যায় তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু। আগের রাতে যিনি বাড়িতে ফোন করে সুস্থভাবেই কথা বললেন, তাঁরই শবদেহ পরদিন সকালে এসে পৌঁছায় দিল্লি বিমানবন্দরে। কীভাবে সম্ভব? ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন তাসখন্দে? নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের মত লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু রহস্য আজও অধরা রয়ে গেছে।
স্বাধীন ভারতে জওহরলাল নেহেরুরপরে দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। ১৯০৪ সালের ২ অক্টোবর মুঘলসরাইতে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জন্ম হয়। একই দিনে ১৮৬৯ সালে জন্মেছিলেন মহাত্মা গান্ধীও। মামারবাড়ি মির্জাপুরেই বড় হয়েছেন লাল বাহাদুর। ভারতের জাত-পাত ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি নিজের পদবি ‘শ্রীবাস্তব’ ত্যাগ করেন এবং স্নাতক হওয়ার পর প্রাপ্ত ‘শাস্ত্রী’ উপাধি থেকেই তিনি লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হিসেবেই পরিচিত সকলের কাছে। ভার্গিস কুরিয়ানের সহায়তায় ভারতে দুগ্ধ উৎপাদন শিল্পে যে শ্বেত বিপ্লব ঘটে যায়, তার অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীও। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতে দেখা দেয় খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ। আর সেই সময় আপামর নিরন্ন ভারতবাসীর কথা চিন্তা করে মন্ত্রী হিসেবে নিজের বেতন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। এমন সৎ, নিষ্ঠাবান ও নীতিপরায়ণ প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু রহস্য আজও ভারতবাসীকে ভাবিয়ে তোলে।
নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্যকে ঘিরে আজও অনেক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে নেতাজীর অন্তর্ধান সংক্রান্ত ৬৪টি গোপন ফাইল প্রকাশ করা হয় যা তাঁর অন্তর্ধান বিতর্ককে আরও উস্কে দেয়। একইভাবে তাসখন্দে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু রহস্যের কিনারা করতে অনেকে অনেকভাবে চেষ্টা করেছেন। তবে একটা ব্যাপারে সকলেই একমত যে এই মৃত্যু কোনও মতেই স্বাভাবিক ছিল না। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর পুত্র অনিল শাস্ত্রী সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে তাঁর বাবার থার্মোফ্লাস্কে দুধের মধ্যে সম্ভবত বিষ মেশানো ছিল আর অভ্যাসবশত মৃত্যুর আগের দিন রাতে দুধ খেয়ে শোয়ার ফলেই শরীরে বিষক্রিয়া হয় এবং তাঁর মৃত্যু হয়। তবে এই মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি আজও। বিষক্রিয়া প্রমাণের জন্য পোস্ট-মর্টেম প্রতিবেদনই তো যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তারপরেও পোস্ট-মর্টেম করা হয়নি। কেন? বাধাটা ছিল কোথায়? নাকি পোস্ট-মর্টেম করা হলেও সেই প্রতিবেদনের কাগজটিকেই লোপাট করে দেওয়া হয়েছিল? প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার অনেকে দাবি করেন যে হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছিল লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর। ঠিক কোন ষড়যন্ত্র লুকিয়েছিল এই মৃত্যুর পিছনে? পাঁচ দশক পরে আজও লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মৃত্যু রহস্য নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
সাল ১৯৬৪। ভারত স্বাধীন হয়ে গিয়েছে ১৭ বছর আগে। প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জওহরলাল নেহেরুর মেয়াদ ফুরিয়েছে। তাঁর পরে ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। কিন্তু যে সময় ভারত শাসনের দায়িত্ব পান তিনি, সেটা খুব একটা স্থিতিশীল সময় ছিল না। দিকে দিকে বেজে উঠেছিল যুদ্ধের দামামা। অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল দেশ, বারুদের গন্ধ পাচ্ছিল দেশের মানুষ। ১৯৬২ সালে শুরু হয়েছিল চিন-ভারত যুদ্ধ। লাল ফৌজ তখনও মাঝে-মধ্যেই আকস্মিক হামলা চালাচ্ছিল ভারত সীমান্তে। এরই মধ্যে পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। পরপর দুটো যুদ্ধ হোক লাল বাহাদুর শাস্ত্রী নিজে কখনই চাননি। একে অর্থাভাব, তার উপর খাদ্য সংকট সব মিলিয়ে দেশের মানুষের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না। ১৯৬৫ সালে রণাঙ্গনে নামল ভারত। একদিকে যুদ্ধ চলছে, আর অন্যদিকে এই সংকটে দেশবাসীকে মনোবল যোগাতে নানাবিধ প্রয়াস করছেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। এরই মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান দুই যুযুধান পক্ষই সন্ধি করতে সম্মত হয়। আশা দেখা যায়, যুদ্ধ বন্ধ হবে। নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে তাসখন্দে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষর করলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। থামল যুদ্ধ। চুক্তি সেরে হোটেলে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর বরাবরের অভ্যাস রাতে শোবার আগে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে শোওয়া। সেদিনও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। হোটেলে ফিরে রাতে খাওয়ার পরে বাড়িতে ফোন করেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র অনিল শাস্ত্রী জানিয়েছিলেন যে, সেদিন ফোনে লাল বাহাদুর নাকি তাঁদের বলেছিলেন তাসখন্দে এক অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে লাল বাহাদুরের সাক্ষাতের কথা। এমনকি তিনি নাকি এও উল্লেখ করেন যে সেই মানুষের কথা দেশে এসে জানালে সকলে অবাক হয়ে যাবেন। স্বভাবতই প্রশ্ন দানা বেঁধে ওঠে সেই আগন্তুক ব্যক্তিকে ঘিরে। কে ছিলেন সেই মানুষটি? পরবর্তীকালে ছবিতে সেই আগন্তুক ব্যক্তির দেখাও মেলে। অনেকে অদ্ভুতভাবে দাবি করে বসেন যে সেই আগন্তুক আর কেউ নন, স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। যদি সেই মানুষটি সত্যই নেতাজী হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে একমাত্র লাল বাহাদুর শাস্ত্রীই সদুত্তর দিতে পারতেন আর তাঁরই কিনা সেই রাত্রেই হৃদরোগ দেখা দিল! বুকে যন্ত্রণা অনুভব করার কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। একেবারে কাকতালীয় ঘটনা বলেই মনে হতে পারে আপাতভাবে। পরদিন সকালে দিল্লি বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় তাঁর মৃতদেহ। সেই মৃতদেহ দেখে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ছেলে অনিল শাস্ত্রী অদ্ভুতভাবে লক্ষ করেন তাঁর বাবার সারা শরীর নীল হয়ে গিয়েছে আর একইসঙ্গে শরীরের সর্বত্র নীল ও সাদা রঙের দাগ ছিল, পেটে ও গলার পিছনে কাটা দাগও ছিল। তাঁর পরিবারের সকলেই দাবি করেছিলেন যে সেই নীলাভ রঙ আসলে শরীরে ছড়িয়ে পড়া বিষক্রিয়ার কারণে হয়েছে। কিন্তু তবু আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়। তাসখন্দে মারা যাওয়ার পরে তার দেহ নাকি সেখানে পোস্ট-মর্টেম করা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃতদেহে পেটে ও গলার কাছে কাটা দাগ রয়েছে, ঠিক ময়না তদন্তের মতই। ফলে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। যদি ময়না তদন্ত হয়েই থাকে, তবে তার প্রতিবেদন গেল কোথায়? তবে কি সত্যই কোনও রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী? আর চক্রান্তকারীরাই কি তাহলে সেই ময়না তদন্তের প্রতিবেদন লোপাট করে দিয়েছিল? একের পর এক প্রশ্ন উঠতে থাকে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে।
অন্যদিকে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক আর এন চুগের মত হল মৃত্যুর আগে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থই ছিলেন, ফলে হৃদরোগে মৃত্যুর সম্ভাবনাই নেই। তাসখন্দ সফরে শাস্ত্রীজির সঙ্গেই ছিলেন আর এন চুগ। ফলে এই মৃত্যু রহস্যের অন্যতম সাক্ষী চিকিৎসক চুগ। এছাড়াও আরেক সাক্ষী ছিলেন শাস্ত্রীজির ভৃত্য রামনাথ। আশ্চর্যজনকভাবে পরবর্তীকালে একই সঙ্গে মৃত্যু হয় রামনাথ ও চিকিৎসক আর এন চুগের। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু রহস্যকে ঘিরে যে তদন্ত কমিশন বসেছিল, সেখানে সাক্ষ্যও দিয়েছিলেন এই দুজন। সময়টা তখন ১৯৭৭ সাল। লাল বাহাদুরের মৃত্যুর পরে তিনি হোটেলের যে ঘরে ছিলেন, তার খানসামাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিছুদিন পরে সে ছাড়াও পেয়ে যায়। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর স্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সেই খানসামার নিরুদ্দেশের সংবাদ দেয় পুলিশ। একটি মৃত্যুকে ঘিরে এত এত রহস্য পরপর দানা বেঁধে উঠছে যা একটা উৎকৃষ্ট ক্রাইম থ্রিলারকেও হার মানাবে। শুধু তাই নয়, পরে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর দুই ছেলে অনিল শাস্ত্রী ও সুনীল শাস্ত্রীও মারা যান রহস্যজনকভাবে। লাল বাহাদুরের পরিবারে দাবি ছিল প্রতিদিন রাতে যে দুধ খেয়ে শোওয়ার অভ্যাস ছিল লাল বাহাদুরের, সেই দুধের থার্মোফ্লাস্কটি হোটেলের ঘরে তাঁর বিছানার পাশেই রাখা ছিল। পরিবারের দাবি যে সেই থার্মোফ্লাস্কটির মধ্যেই কিছু মেশানো ছিল। এমনকি তদন্ত কমিশনে দেওয়া সাক্ষ্যে চিকিৎসক আর এন চুগও রাত্রে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর টেবিলে সেই থার্মোফ্লাস্ক দেখেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু আবারও এক ধোঁয়াশা। মৃত্যুর পরে সেই থার্মোফ্লাস্কটিও আর পাওয়া যায়নি ঘরে, সেইসঙ্গে লোপাট হয়ে গিয়েছে লাল বাহাদুরের ডায়েরিও। এত এত রহস্যের ‘ক্লু’ থেকে আন্দাজ করাই যায় লাল বাহাদুরের মৃত্যুটা কোনওভাবেই স্বাভাবিক ছিল না এবং সম্ভবত তা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ঠান্ডা মাথার ‘খুন’। কোন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন তিনি? লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মৃত্যু রহস্য থেকে এর সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীকালে তাঁর পরিবারের সদস্যরা লাল বাহাদুরের মৃত্যু রহস্য সংক্রান্ত গোপনীয় তাসখন্দ ফাইলগুলি প্রকাশের আর্জি জানিয়েছিল ভারতের তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু বিশেষ সুরাহা হয়নি। সম্প্রতি পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী এই গোপন ফাইলগুলির প্রেক্ষাপটেই নির্মাণ করেছেন একটি চলচ্চিত্র যার নাম ‘তাসখন্দ ফাইলস’। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সেই ছবি মুক্তি পেয়েছে ২০১৯ সালে।
: সংগৃহীত