বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
হাতে কাজ নেই, চুপচাপ বসে আছেন, পট-পট করে হাতের আঙুলগুলো ফাটিয়ে নিলেন হয়ত। কিংবা সারাদিনে অনেক কাজ করে ক্লান্ত, আবারও আঙুল ফাটিয়ে ভাবলেন যাক একটু আরাম পাওয়া গেল। এই ঘটনা আমাদের সঙ্গে প্রায়শই ঘটে। আঙুল ফাটানোর মতো কাজ আমরা নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছি হয়ত। কেউ বলেন এটা খারাপ অভ্যাস, হাড় ক্ষয়ে যায়। আবার কেউ বলেন পরবর্তীকালে এর ফলে নাকি বাত, আর্থ্রাইটিস হতে পারে। কেউ কেউ এই সব কথায় কান না দিয়ে পট-পট করে একের পর এক আঙুল ফাটিয়ে চলেন। কিন্তু জানেন কী, আসলে কেন হয় এই আঙুল ফাটার শব্দ বা আঙুল ফাটে কীভাবে? আঙুলের ভিতরে তো হাড়ই থাকে, তা সেই হাড় আসলে কীভাবে ফাটে, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
আমাদের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় অস্থিসন্ধি রয়েছে। অর্থাৎ দুটো হাড় যেখানে একজায়গায় এসে মিশেছে সেই অঞ্চলকে অস্থিসন্ধি বলা হয়। অস্থিবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখলে, এই অস্থিসন্ধিগুলিতে দুটি হাড়ের মাঝে থাকে সাইনোভিয়াল তরল (Synovial Fluid)। এই তরল হাড়ের ক্ষয় রোধ করে এবং হাড়ের সঞ্চালন আরও সুগম করে। যেভাবে গাড়ির মোটরে তেল দিয়ে বা কোন যন্ত্রে তেল দিয়ে তার ঘর্ষণ কমানো হয় তাকে টেকসই রাখার জন্য, আরও ভালোভাবে কাজ করার জন্য, ঠিক সেভাবেই আমাদের শরীরেও অস্থিসন্ধিগুলিতে এই সাইনোভিয়াল তরল হাড়ের ক্ষয় ও ঘর্ষণ কমাতে সাহায্য করে এবং একইসঙ্গে আমাদের তরুণাস্থিগুলিকেও অক্ষত রাখতে সাহায্য করে। অনেক গবেষক অনেকরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই আঙুল ফাটার কারণ সম্পর্কে তবে সর্বজনস্বীকৃতভাবে বলা যায় যে, আঙুলের সন্ধিস্থলে যে সাইনোভিয়াল তরল থাকে তার মধ্যে বায়ুর বুদবুদও থাকে দুটি হাড়কে শক্ত করে দু ধারে ধরে রাখার জন্য। আঙুল ফাটানোর সময় চাপে ঐ বায়ুর বুদবুদগুলি ফেটে যায় বলেই এমন শব্দ হয়। আরেকটু বিশদে বলা যাক। অস্থিসন্ধিতে থাকা সাইনোভিয়াল তরল হাড় দুটিকে দু ধারে ঠিকঠাকভাবে চেপে ধরে রাখে আর এর ফলে অস্থিসন্ধির গহ্বরে (Joint Cavity) চাপ কম তৈরি হয়। আমরা এর জন্য খুব সহজে হাতের আঙুল ভাঁজ করতে পারি। এখন দেখা গেছে, এই তরলের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন দ্রবীভূত থাকে। যেইমাত্র আঙুল ফাটানো হয় তখন প্রথমে অস্থিসন্ধিতে কিছুটা ফাঁকা অংশের সৃষ্টি হয় যার ফলে সাইনোভিয়াল তরলের উপর চাপ কম হয় ফলস্বরূপ ওই তরলে দ্রভীভূত বায়ু বুদুবুদ আকারে বেরিয়ে আসে ও অস্থিসন্ধির গহ্বরে জায়গা করে নেয়। এরপর আবার অস্থিসন্ধিতে হাড়গুলি আগের অবস্থায় ফিরে এলে গহ্বরে চাপ বাড়ে ও সদ্য তৈরি হওয়া গ্যাসের বুদবুদটি ফেটে যায়। এই গ্যাসের বুদবুদ ফাটার শব্দই আমরা পাই আর একেই আমরা আঙুল ফাটানো বলি। একবার আঙুল ফাটানোর পরে ঐ সাইনোভিয়াল তরলের মধ্যে এবং গহ্বরের মধ্যে বায়ু জমতে আরো কিছু সময় লাগে, সেই বিশেষ সময়ের মধ্যে আর আঙুল ফাটানো যায় না। একে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘রিফ্র্যাক্টরি পিরিয়ড’ (Refractory Period)। প্রায় কুড়ি মিনিট সময় ধরে ঐ গ্যাসগুলি আবার সাইনোভিয়াল তরলের মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে যায়।
এই আঙুল ফাটানো নিয়ে অনেকের মনে অনেকরকম মনোভাব আছে। কেউ বলেন এই খারাপ অভ্যাস ভবিষ্যতে হাড়ের ক্ষয় করবে, কেউ আবার বলেন আঙুল ফাটানোর ফলে আর্থ্রাইটিস দেখা দিতে পারে। এই প্রসঙ্গেই আঙুল ফাটানোর কোন খারাপ প্রভাব আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে ডোনাল্ড উঙ্গার নামের একজন চিকিৎসক ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর বাঁ-হাতের আঙুলগুলি নিয়মিত ফাটান এবং ডান হাতের আঙুলে কিছু করেন না। এই দীর্ঘ অভ্যাসের পরে দেখা যায় তাঁর বাঁ হাত বা ডান হাত কোথাও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বাঁ হাতে এতবার আঙুল ফাটানোর পরেও তাতে আর্থ্রাইটিস হয়নি। এই অদ্ভুত পরীক্ষা করার জন্য ২০০৯ সালে ডোনাল্ড উঙ্গারকে ‘ইগ নোবেল পুরস্কারে’ (Ig Nobel Prize) ভূষিত করা হয়। তবে আঙুল ফাটানোর ক্ষতিকর প্রভাব খুব বেশি না থাকলেও, যদি কোন ক্ষেত্রে ব্যাথার অনুভূতি হয় তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আশা করি, এরপরে যখন আঙুল পটপট করে ফাটাবেন তখন আঙুল ফাটে কীভাবে সেই কথাও একবার মনে পড়বে।