এ.পি.জে আব্দুল কালাম ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি ও বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) এবং ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) -এ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন। ভারতের সামরিক ‘গাইডেড মিসাইল’ সংক্রান্ত কর্মসূচীর সাথে তিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিলেন বলে তাঁকে ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়ে থাকে। ১৯৯৮ সালে পোখরান-২ পরমাণু বোমা পরীক্ষায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
তাঁর সম্পূর্ণ নাম আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম৷ তিনি ‘Missile Man’ নামে পরিচিত হয়ে আছেন৷ ১৫ অক্টোবর ১৯৩১ সালে তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে আব্দুল কালামের জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম৷ তাঁর বাবার নাম জয়নুল-আবেদিন এবং মায়ের নাম অশিয়াম্মা । তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন একজন নৌকা মালিক এবং স্থানীয় মসজিদের ইমাম। প্রতিদিন হিন্দু তীর্থযাত্রীদের রামেশ্বরম ও তার সংলগ্ন ধনুষ্কোডিতে পারাপার করাতেন তিনি। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ার জন্য খুব অল্প বয়স থেকেই আব্দুল কালামকে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য কাজ করতে হয়৷
কালামের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় রামনাথপুরম স্কোয়ার্টজ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে। দারিদ্র্যতার কারণে ছোটবেলায় খবরের কাগজ বিক্রি করেই তিনি নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। পড়াশোনায় সাধারণ মানের ছাত্র হলেও তিনি ছিলেন পরিশ্রমী এবং মেধাবী৷ ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি পড়াশোনা করতেন, বিশেষ করে অঙ্ক ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়৷ স্কুলের পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর, তিনি ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজে এবং সেখান থেকে ১৯৫৪ সালে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেন৷ এরপর ১৯৫৫ সালে তিনি চেন্নাইয়ে চলে আসেন এবং সেখানকার মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে বিমানপ্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করেন। কালাম যখন সিনিয়র ক্লাস প্রকল্পে কাজ করছিলেন, তাঁর প্রকল্প শেষ হতে দেরী হচ্ছিল বলে কলেজের ডিন তাঁর কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি জানান পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ না করা হলে তাঁর বৃত্তি প্রত্যাহার করা হবে৷ কালাম তিন দিনের সময়সীমার মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করে ডিন কে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। এবং বলেছিলেন।
কালাম একজন যুদ্ধ বিমানের পাইলট হতে চেয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর পরীক্ষায় বসেছিলেন। শূন্যপদ ছিল আটটি। কালাম নবম স্থান অধিকার করেছিলেন ফলে যুদ্ধ বিমান চালনার স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে যায়।
কালামের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬০ সালে৷ তিনি মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে পাশ করার পর বিজ্ঞানী হিসেবে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ডিআরডিও) অন্তর্ভুক্ত অ্যারোনটিকাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাবলিশমেন্টে যুক্ত হন৷ জীবনের শুরুতে তিনি একটি ছোট হোভারক্রাফ্ট ডিজাইনের মাধ্যমে তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। এরপর ১৯৬২ সালে কালাম ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো)-তে যোগ দেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন মহাকাশ সম্পর্কীত পরিকল্পনার পরিচালনা করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি আমেরিকার ভার্জিনিয়ার হ্যাম্পটনে নাসার ল্যাংলে রিসার্চ সেন্টারে গিয়েছিলেন৷ ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (PSLV) এবং এসএলভি-তৃতীয় প্রকল্পগুলির উন্নতির চেষ্টা করেছিলেন। এই দুটো প্রকল্পই সফল হয়েছিল পরবর্তীকালে।
১৯৯৮ সালে কালামের নেতৃত্বে ভারত দ্বিতীয়বারের জন্য পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষা করতে পেরেছিল। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের এই সফলতা সেইসময়ে তাঁকে ভারতের সবথেকে বিখ্যাত এবং সফল পরমাণু বৈজ্ঞানিক হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
২০০২ সালে নির্বাচনী ভোটে জিতে কালাম ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন৷ তিনি নির্বাচনে ৯২২,৮৮৪ ভোটে জয় লাভ করেন। ২৫ জুলাই ২০০২ থেকে ২৫ জুলাই ২০০৭ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির পদে আসীন ছিলেন তিনি৷ রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনগণের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল৷ তিনি জনগণের কাছে এতটাই শ্রদ্ধার সঙ্গে গৃহীত হয়েছিলেন যে তাঁকে ‘জনগনের রাষ্ট্রপতি’বলে অভিহিত করা হয়৷
কালাম ছিলেন দেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি যিনি ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০০৭ সালে কালামের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি ভারতের বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রফেসর হিসাবেও যুক্ত ছিলেন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (শিলং), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (আহমেদাবাদ), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (ইন্দোর) এবং ব্যাঙ্গালোরে ভারতীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানেও তিনি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছিলেন। এছাড়া তিনি আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক হিসাবেও যুক্ত হয়ে ছিলেন।তিনি হায়দ্রাবাদের আন্তর্জাতিক তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউ, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য প্রযুক্তির অধ্যাপক ছিলেন।
২০১২ সালের মে মাসে তিনি যুব সমাজের জন্য ‘What Can I Give Movement” নামে দুর্নীতি বিরোধী কর্মসূচীর সূচনা করেন।
কালামের প্রাপ্ত পুরস্কার ও উপাধির সংখ্যা ছিল প্রচুর৷ তিনি ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন৷ তিনি ১৯৮১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ সম্মান লাভ করেন। (ইসরো) এবং (ডিআরডিও)-এ কাজ করার জন্য ও ভারত সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসাবে থাকার জন্য ১৯৯০ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ উপাধি লাভ করেন৷ ১৯৯৪ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ডিরেক্টরস কর্তৃক “Distinguished Fellow” পুরস্কার লাভ করেন তিনি৷ ১৯৯৭ সালে ভারতরত্ন পুরস্কারের পাশাপাশি তিনি ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কারও পেয়েছিলেন৷ ১৯৯৮ সালে পেয়েছিলেন বীর সাভারকার পুরস্কার। চেন্নাইয়ের আলওয়ার গবেষণা কেন্দ্র থেকে ‘রামানুজন পুরস্কার’ লাভ করেন ২০০০ সালে। ২০১০ সালে ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক “ডক্টরস অফ ইঞ্জিনিয়ারিং” সম্মানে তিনি ভূষিত হন৷ ন্যাশনাল স্পেস সেসাইটির দ্বারা ২০১৩ সালে তিনি ভন্ ব্রাউন অ্যওয়ার্ড (Von Braun Award) লাভ করেন। ২০১২ সালে আউটলুক ইন্ডিয়ার ভোটে আব্দুল কালাম “The Greatest Indian” হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন৷ ২০১৫ সালে ওড়িশায় অবস্থিত হুইলার আইল্যান্ডের নতুন নামকরণ করা হয় আবদুল কালাম আইল্যান্ড নামে৷ বিশাখাপত্তনমে অবস্থিত ভারতের প্রথম মেডিক্যাল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট Kalam Institute of Health Technology তাঁর নামে করা হয়েছে৷
কালামের আত্মজীবনী ‘Wings of Fire’ ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়৷ এছাড়া বেশ কিছু বই তিনি লিখেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ” Developments in Fluid Mechanics and Space Technology ” ( ১৯৮৮) ,” India 2020 : A Vision for the New Millennium”( ১৯৯৮) , “Target 3 Billion”( ২০১১), ” Transcendence: My Spiritual Experiences with Pramukh Swamiji ” ( ২০১৫) প্রভৃতি৷
কালাম ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (শিলং)-এ “Creating a Livable Planet Earth” বিষয়ক একটি বক্তৃতা দিতে গেছিলেন৷ বিমানে বসে তিনি শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করেন৷ কিন্তু শিলং-এ পৌঁছে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে তিনি অডিটোরিয়ামে বক্তব্য রাখতে যান। বক্তব্য শুরু করার মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়৷