ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানান জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নানা সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নাথুরাম গডসের হাতে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর থেকে শুরু করে কংগ্রেসী রাজত্বে কখনও ইন্দিরা গান্ধী, কখনও রাজীব গান্ধী রহস্যজনকভাবেই দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গিয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক শোকাবহ ঘটনা। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের দায়ভার কাঁধে তুলে নেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারান ইন্দিরা। ভারতের লৌহ মানবী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের আড়ালে কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে, চলুন তা জেনে নেওয়া যাক।
ভারতের একমাত্র এবং প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। জওহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই তাঁকে সরকারি নানা কাজে সহায়তা করতেন তাঁর কন্যা ইন্দিরা। নেহেরুর সঙ্গে বহুবার বিদেশ সফরেও সঙ্গী হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরে সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে পদার্পণ করেন ইন্দিরা গান্ধী। পরে ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যু হলে, রাজ্যসভার সদস্য হন ইন্দিরা। এই সময় লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রীসভায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিদ্বন্দ্বী মোরারজি দেশাইকে পরাজিত করে ভারতের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৮৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর আমলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইন্দিরা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত যে জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা, তার জন্য ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়েছেন তিনি। আপোসহীন মনোভাব এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অধিকারে ইন্দিরা গান্ধী সত্যই ভারতের লৌহমানবী ছিলেন। কিন্তু ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর কড়া নিরাপত্তা সত্ত্বেও দুই দেহরক্ষীর গুলিতে মারা যান ইন্দিরা। রাজনৈতিক মহলে ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড আজও এক বহুচর্চিত বিষয়।
তাঁর হত্যাকাণ্ডের পিছনে প্রধানতম কারণ হিসেবে ‘অপারেশন ব্লু-স্টার’-এর প্রভাবকে দায়ী করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১ জুন থেকে ৮ জুনের মধ্যে পাঞ্জাবের অমৃতসরে যে সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়, তাকেই অপারেশন ব্লু-স্টার নাম দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে সহিংস শিখ নেতা জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে এবং তাঁর অনুগামীদের স্বর্ণমন্দিরের হরমন্দির সাহিব থেকে উচ্ছেদ করার জন্যেই এই অভিযান চালানো হয়। সমগ্র অমৃতসর জুড়ে ভিন্দ্রানওয়ালে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। প্রায় ৫০০ জন মানুষ এর ফলে মারা যায়, এমনকি নৃশংসতার বিরোধিতার ফলে ৩৯ জন শিখ নাগরিককেও হত্যা করা হয়। ফলে ইন্দিরা গান্ধী ভিন্দ্রানওয়ালেকে আটক করার জন্য তৎপর হয়ে পড়েন। হরচাঁদ সিং-এর পরামর্শে স্বর্ণমন্দিরের ভিতরেই ঘাঁটি তৈরি করে ভিন্দ্রানওয়ালে এবং তাঁর বাহিনী। তাদের মনে হয়েছিল মন্দির আক্রমণ করতে পারবে না ইন্দিরা গান্ধীর সেনারা। কিন্তু তাদের মনোভাবকে ভুল প্রমাণিত করে অপারেশন ব্লু-স্টার পরিচালনা করেন ইন্দিরা গান্ধী। সেনারা ঢুকে পড়ে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে এবং ভিন্দ্রানওয়ালে সেই অভিযানে নিহত হন, কিন্তু একইসঙ্গে স্বর্ণমন্দিরেরও বেশ কিছু ক্ষয়-ক্ষতি হয় যা শিখদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে শিখ সেনারা ইস্তফা দেন। প্রতিবাদস্বরূপ শিখ নাগরিকরা অনেকে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন, সরকারি চাকরি থেকেও ইস্তফা দেন। এই অপারেশন চলার সময় ৮৩ জন ভারতীয় সেনা মারা যায়, ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ গুরুতরভাবে আহত হন এবং প্রায় ৫০০ জন শিখ সেনার মৃত্যু হয়। স্বর্ণমন্দিরে সেই সময় সাধারণ পুণ্যার্থীরাও উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যেও অনেক নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয় এই অভিযানের সময়। এই ঘটনার ফলে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। ভারতের গোয়েন্দা বিভাগের নির্দেশে প্রাথমিকভাবে ইন্দিরা গান্ধীর শিখ দেহরক্ষীদের অপসৃত করা হয়, কারণ সেই সময় তারা মনে করেছিলেন যে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে শিখ দেহরক্ষীরাই সম্ভবত ইন্দিরাকে হত্যার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু এই কাজের ফলে জনমানসে ইন্দিরা গান্ধীর শিখ-বিরোধী মনোভাব প্রকাশ্যে আসার আশঙ্কায় এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন তিনি। ফলে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী দুই শিখ দেহরক্ষীকে পুনর্বহাল করে। এদের মধ্যে ছিলেন বিয়ন্ত সিং এবং সতওয়ান্ত সিং।
মৃত্যুর আগের দিন অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের ৩০ অক্টোবর উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে একটি জনসভায় দুর্ধর্ষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রতিবারের মত সেবারেও এইচ ওয়াই শারদাপ্রসাদ তাঁর বক্তৃতাটি লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু বক্তৃতার মাঝখান থেকে লিখিত বয়ানের বাইরে মন থেকেই বেশ কিছু কথা বলতে থাকেন ইন্দিরা। তাঁর সেদিনের কথাগুলির মধ্যে কোথাও একটা মৃত্যুর আভাস লুকিয়েছিল। সেই দিন রাতে দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন ইন্দিরা, পরদিন সকাল সাতটায় তাঁর সাক্ষাৎ করার কথা পিটার উস্তিনভের সঙ্গে। পিটার সেই সময় মহাত্মা গান্ধীর উপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছিলেন এবং সেই কারণেই ইন্দিরা গান্ধীর একটি সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন তিনি। সব কাজ সেরে সকাল নটা দশ নাগাদ বাইরে বের হন ইন্দিরা গান্ধী। সিপাহি নারায়ণ সিং একটি ছাতা নিয়ে ইন্দিরার পাশে পাশেই হাঁটছিলেন, পেছনে ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান এবং পরিচারক নাথুরাম শর্মা। সেই দিন রাত্রে ব্রিটেনের রাজকুমারী অ্যানের ভোজসভায় পৌঁছানোর কথা ছিল ইন্দিরার, সেই বিষয়ে ব্যক্তিগত সচিবকে পরামর্শ ও কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন তিনি। ঐ সময়েই নিউ দিল্লির সফদর জং রোডে ইন্দিরা গান্ধীর বাড়িতেই সকাল ৯টা ২৯ মিনিটে শিখ দেহরক্ষী বিয়ন্ত সিং ইন্দিরাকে লক্ষ্য করে হঠাৎ গুলি চালান। প্রথমে পেটে গুলি লাগে ইন্দিরার, পরে একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে বুকে আর কোমরে গুলি করেন বিয়ন্ত সিং। কিছুদূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সতওয়ান্ত সিং, সঙ্গে ছিল তার অটোমেটিক কার্বাইন আগ্নেয়াস্ত্র। ইন্দিরা গান্ধী মাটিতে পড়ে যাওয়া মাত্রই পরপর ২৫টি গুলি চালান সতওয়ান্ত। ইন্দিরাকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত হন নিরাপত্তা অফিসার রামেশ্বর দয়াল। আকবর রোডে ইন্দিরা গান্ধীর দপ্তর থেকে ছুটে আসেন পুলিশ অফিসার দীনেশ কুমার ভট্ট। কিন্তু ততক্ষণে সতওয়ান্ত সিং এবং বিয়ন্ত সিং অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের কয়েকজন তৎক্ষণাৎ ঘিরে ফেলে সতওয়ান্ত সিংকে। সাদা অ্যাম্বাসাডারে করে ইন্দিরা গান্ধীকে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির এইমস (AIIMS) হাসপাতালে। ইন্দিরা গান্ধীর অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। শরীরের ভিতরে আটকে থাকা ৭টি গুলি বের করে ডা. তিরথ দাস ডোগরা পুলিশের হাতে তুলে দেন ব্যালিস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য। মুখ দিয়ে নল ঢুকিয়ে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। প্রায় ৮০ বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরাকে। গুলির আঘাতে তাঁর যকৃৎ, ক্ষুদ্রান্ত, বৃহদন্ত্র এমনকি পাঁজরের হাড়ও ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দুপুর ২টো ২৩ মিনিটে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। ইতিমধ্যে ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়া বিয়ন্ত সিংকে গুলি করে মেরে ফেলে পুলিশ। অপরদিকে সতওয়ান্ত সিংকে আটক করা হয় বিচারের জন্য। ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি অপরাধী সতওয়ান্ত সিংকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
দুপুরবেলা মারা গেলেও ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর খবর দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হয় সন্ধ্যেবেলা এবং ঐ দিনই রাত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ছাড়াই দেশের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন রাজীব গান্ধী। তারপর থেকেই দীর্ঘকাল যাবৎ সমগ্র দেশ জুড়ে দাঙ্গা বেধে যায়। ইন্দিরার ঘাতক শিখ হওয়ায় শিখদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহাবশত আক্রমণ হানা শুরু করেন সাধারণ মানুষ। পরবর্তী ৪ বছরে প্রায় ৮ হাজার শিখ নাগরিককে হত্যা করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তদন্তের জন্য গঠিত হয় ‘ঠক্কর কমিশন ফর এনকোয়ারি’। এই কমিশনের প্রতিবেদনে সতওয়ান্ত সিং এবং তার সহায়ক কেহর সিংকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ইন্দিরার ঘাতক দুই দেহরক্ষীর ভূমিকা নিয়ে একটি পাঞ্জাবি ছবি ‘কৌম দে হিরে’ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালের ২২ আগস্ট, কিন্তু অনিবার্য কারণে সেই ছবিকে ৫ বছর যাবৎ ভারত সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।