বারী সুমন:
একসময় বাংলাদেশে পালকির ব্যাপক প্রচলন ছিল। শুধুমাত্র ধনী, শৌখিন ব্যক্তিরাই এই পালকি ব্যবহার করত। বেহারারা কাঁধে করে পালকি নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত। পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগ বিয়ে-শাদির কাজে পালকি ব্যবহৃত হতো। বর পালকি চড়ে যেত তারপর নতুন বউকে পালকিতে চড়িয়ে নিয়ে আসত।
আমরা কেবল বিয়ে-শাদির কাজে পালকির ব্যবহারটুকু দেখেছি। চৌকোণা কাঠের কারুকার্যমণ্ডিত ছোট্ট একটি ঘরের মতো বাহন বিশেষ। দু’পাশে দুটি দরজা থাকত। দরজাগুলো কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকত। পালকির এ পাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত শক্ত বাঁশ বা কাঠের একটি দণ্ড থাকত। যার মধ্যে বেহারা পালকিটিকে কাঁধে নিত। দু’পাশে দু’জন করে মোট চারজন বেহারা থাকত। বেহারা সাধারণত সাদা ধুতি পরত, মাথায় এবং কোমরে লাল গামছা বাঁধা থাকত। হাতে থাকত একটি করে লাঠি। পালকি নিয়ে চলার সময় বেহারা বিভিন্ন ধরনের গান বা সুর করে ছড়া কাটত, যা শুনতে অনেক ভালো লাগত। রাজবাড়িতে নাকি একসময় হাতির দাঁতের পালকি দেখা যেত।
পালকির ভেতরে বসে পুরোটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে স্বামীর বাড়ি আসত স্ত্রী? এই পালকির ভেতরে বসে তার মনে কত ভয়-ভীতি, অজানা আশঙ্কা, কান্না কত কথা, কত স্মৃতি যে পালকির ভেতরে পড়ে থাকত তা কেবল সেই জানত, যে পালকি চড়ে আসত। বউদের সম্মানের সাথে আনার জন্য পালকি ছাড়া কোনো উপায়ই ছিল না। আর কিছু পরিবার ছিল যারা বংশ পরম্পরায় এই পেশায় জড়িত ছিল। তবে তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। বেহারা কম থাকার কারণে পালকির চাহিদা ছিল প্রচুর। প্রতিদিনই তাদের কোনো না কোনো জায়গায় যেতে হতো। পালকির দরকার পড়লে বেশ কয়েকদিন আগে বেহারাদের সাথে যোগাযোগ করতে হতো। তা না হলে পালকি পাওয়া যেত না। কারণ হয়তো সেদিন অন্য কেউ পালকির জন্য বায়না করে রেখেছে।
এখনকার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। ফোন মোবাইল ছিল না। তাই যাদের পালকি দরকার তারা সপ্তাহখানেক আগেই বেহারাদের বাড়িতে গিয়ে পালকির জন্য বায়না করে আসত। বিয়ে উপলক্ষে পালকিকে রঙিন কাগজের ঝালর কেটে সাজানো হতো। বেহারাদের উহুমনা উহুমনা সুরে মুখরিত করত তাদের চলার পথ। যে পথে পালকি নিয়ে যেত, সেদিকের আশপাশের বাড়ির ছোট-বড় সবাই বেরিয়ে আসত পালকি দেখার জন্য আর তাদের সেই পালকি চলার সময় ছড়া বা গান শোনার জন্য।
বর্তমান সময়ে পালকি আর চোখে পড়ে না। বর্তমান প্রজন্মও পালকির সাথে পরিচিত নয়। জাদুঘরে কিছু পালকির নমুনা সংগ্রহ করা আছে। একমাত্র জাদুঘরেই এখন পালকির দেখা মিলে। কিছু কিছু প্রদর্শনীতে প্রতীকী পালকি প্রদর্শন করা হয়। আবার কিছু কিছু লোকজ অনুষ্ঠানে প্রতীকী পালকি ব্যবহার করে পালকির ব্যবহার সস্পর্কে দর্শকদের ধারণা দেয়া হয়। তবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পালকি একটি কল্পণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সম্ভব হলে আমাদের স্মৃতি পরিষদ, স্কুল-কলেজ, পাঠাগার কিংবা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতীকী পালকি সংরক্ষণ করে এর ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাহলে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পালকি সস্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে তারা।