দিল্লি: ২০ মার্চ ৫-৩০। একটা অধ্যায়ের অবসান। নির্ভয়া-মামলার অবসান। অবশেষে জয় পেল নির্ভয়ার পরিবার। ফাঁসিকাঠে ঝুলল চার অপরাধী।
দীর্ঘ টালবাহানার শেষে চতুর্থ বারের জন্য ঘোষণা হয়েছিল ফাঁসির তারিখ। এর আগে যেভাবে তিন-তিন বার ফাঁসির তারিখ পিছিয়েছে, তাতে সন্দেহ ছিল এই বারও ফাঁসি হবে কিনা। আশঙ্কা ছিল, ফের কোনও আইনি ফাঁক বার করে সুযোগ নিতে পারে অপরাধীরা। সে চেষ্টাও চলেছিল বিস্তর। ফাঁসির দু’দিন আগে থেকেই শুরু হয় একের পর এক আবেদন। এমনকি ফাঁসির ঠিক আগের রাতেও মাঝরাত থেকে শুরু হয় মহানাটক। কিন্তু উত্তেজনার পারা চড়িয়েও, শেষমেশ কোনও অপ্রত্যাশিত রায় আসেনি আদালতের তরফে। নির্ধারিত সময় ও সূচি মেনেই ফাঁসির জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়। ফাঁসি হয়েও যায় ঠিক সময়ে।
সেই ফাঁসি, যার জন্য আট বছর ধরে লড়াই করছে নৃশংসতম উপায়ে ধর্ষিত এক তরুণীর পরিবার। সেই ফাঁসি, যার জন্য আট বছর ধরে প্রতীক্ষা করে রয়েছে দেশের প্রায় প্রতিটা মানুষ। প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে শেষ হয়ে গেল নির্ভয়া গণধর্ষণ ও খুনের মামলার চার অপরাধী পবন গুপ্ত, মুকেশ সিং, অক্ষয় ঠাকুর ও বিনয় শর্মা। পঞ্চম অপরাধী রাম সিং ধরা পড়ার কিছু দিন পরেই আত্মহত্যা করেছিল। ষষ্ঠ অপরাধী নাবালক হওয়ায় ছাড়া পেয়েছে কয়েক বছর সংশোধনাগারে থেকে।
ফাঁসির কয়েক ঘণ্টা আগে নতুন করে সাজা রদের আর্জি নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের চার দোষী। মাঝরাতেই সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের বাড়িতে পৌঁছলেন নির্ভয়া দোষীদের আইনজীবী এপি সিং। শুনানিও শুরু হয় সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু শেষমেশ কোনও আবেদনই ধোপে টেকেনি।
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লিতে একটি বাসে করে বাড়ি ফিরছিলেন প্যারামেডিক্যালের ছাত্রী। সঙ্গে ছিলেন তাঁর এক বন্ধু। চলন্ত বাসে নৃশংস ধর্ষণের শিকার হন তরুণী। তাঁর যোনিতে রড ঢুকিয়ে টেনে বার করে আনা হয় অন্ত্র। প্রবল মারধর করা হয় বন্ধুকেও। চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয় তাঁদের।
দিল্লির হাসপাতালে এবং পরে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে প্রবল লড়াইয়ের পরে ২৯ ডিসেম্বর মারা যান নির্ভয়া। প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে সারা দেশে। ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছিল অপরাধীরা। তৈরি হয়েছিল চার্জশিটও। বিচার পেতে গড়িয়ে গেল এতগুলো বছর।
চরম যন্ত্রণায় মারা যাওয়া এবং মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে দোষীদের বর্ণনা দিয়ে যাওয়া তরুণী নির্ভয়া বিচার পেলেন আজ।
ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম চার জনের ফাঁসি হল একসঙ্গে। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী, ঠিক সময়ে ফাঁসিকাঠে চড়ানো হয় চার জনকে। এর পরে চলে ১২০ সেকেন্ডের কাউন্টডাউন। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে পাঁচটায় ট্রিগার টেনে একসঙ্গে চার অভিযুক্তের ফাঁসি দেন ফাঁসুড়ে পবন। নিয়ম মেনে ৩০ মিনিট ফাঁসিকাঠেই ঝোলে দেহগুলি। তার পর কুয়োয় ফেলে দেওয়া হয় দেহ। শেষে চিকিৎসক এসে পরীক্ষা করেন যে চার জনেই মৃত কি না। তিনি নিশ্চিত করলে কুয়ো থেকে দেহ তুলে নিয়ে চলে যাওয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য।
নির্ভয়া গণধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার এতদিনে শেষ হল, এই গণ-ফাঁসির সঙ্গে। আসামি পবন গুপ্ত, অক্ষয় সিংহ ঠাকুর, বিনয় শর্মা ও মুকেশ সিংহকে মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হওয়ার পর থেকে সাজা কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আইসোলেশন সেলে রাখা হয়েছিল।
যেহেতু সূর্যর আলো ফোটার আগেই ফাঁসি প্রক্রিয়া সমাধা করতে হয়, তাই রাত থাকতেই ডেকে তোলা হয় অপরাধীদের। স্নান করানো হয়, পরানো হয় নতুন পোশাক। আসামিদের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনান ম্যাজিস্ট্রেট। এর পরে মুখে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় তাদের। ফাঁসিকাঠ দেখতে দেওয়া হয় না আসামিদের।
তাদের ফাঁসিকাঠে তোলার সময়ে হাত ধরে থাকেন ওয়ার্ডাররা। ফাঁসির দড়ির ঠিক নীচে দাঁড় করানোর পরে তাদের পা বেঁধে দেন ফাঁসুড়ে। এর পরে তিনিই গলায় দড়ি পরিয়ে দেন। ফাঁস ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কিনা এবং গলায় দড়ি ভাল ভাবে লাগানো হয়েছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখে নেন জেল সুপার। সবশেষে চূড়ান্ত নির্দেশ মিললে ফাঁসি দেন ফাঁসুড়ে।
নির্ভয়া কাণ্ডের এই অপরাধীদের ফাঁসির প্রস্তুতি সারা হয়েছিল গত ডিসেম্বরেই। তিহাড় জেলের আধিকারিকদের সঙ্গে সব ব্যবস্থা পরিদর্শনও করেন পূর্ত দফতরের এক এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। ফাঁসির আগের সন্ধেয় ফের খতিয়ে দেখা হয় সব। শেষমেশ আজ, শুক্রবার, ভোর সাড়ে পাঁচটায় হয়ে যায় ফাঁসি। ময়নাতদন্তের পরে সৎকার করা হবে দেহ।
সৌজন্যে দি ওয়াল