Home First Lead সংকটে পোশাক শিল্প, ক্রয়াদেশ কমে গেছে

সংকটে পোশাক শিল্প, ক্রয়াদেশ কমে গেছে

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি

ঢাকা: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি পোশাক শিল্প  ও বস্ত্রখাতে তৈরি হয়েছে বড় অনিশ্চয়তা। একদিকে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া।

পোশাক খাতের শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইর তথ্য অনুযায়ী, টেক্সটাইল ও ডায়িং কারখানায় ৫০ শতাংশ এবং তৈরি পোশাকে ৩০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। ফলে সময়মতো শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। এ কারণে অনেক বিদেশি ক্রেতা ক্রয়াদেশ বাতিল করছে। এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। ১৫ শতাংশ হয়েছে স্থগিত। কারখানায় জমে থাকা (স্টক লট) পোশাক বাড়ছে। নতুন ক্রয়াদেশও খুব বেশি আসছে না। দুই সংগঠন বলছে, বিদেশি ক্রেতাদের পণ্য পাঠানোর পরও প্রায় ৬০ শতাংশ কারখানা ঠিকমতো বিল পাচ্ছে না। অন্যদিকে জ্বালানি সমস্যার কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও ক্রেতারা পোশাকের দাম বাড়াতে রাজি নয়। একাধিক কারখানা মালিক জানিয়েছেন, গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে অনেক ক্রেতা পণ্য ডেলিভারি স্থগিত করেছে। অক্টোবর ও নভেম্বরের অর্ডারেও একই অবস্থা। কোনো কোনো ক্রেতা এখনকার ক্রয়াদেশ আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য বলছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছয় মাসও পিছিয়ে যাচ্ছে।

পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেখানকার মানুষ গাড়ির জন্য জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাতে গুদামে পণ্যের মজুত বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ দেওয়া কমিয়ে দেয়। ক্রয়াদেশ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম আসছে, এমন তথ্য দিয়ে তৈরি পোশাকশিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, তাদের সবচেয়ে বড় বাজার ইইউ থেকে ক্রয়াদেশ আসার হার খুবই খারাপ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। অনেক কারখানা-মালিককেই ঋণ করে শ্রমিকের মজুরি দিতে হচ্ছে। এখন গ্যাস, বিদ্যুত্সংকট নিরসনে সরকারের বেশি জোর দেওয়া উচিত। যাতে করে যখন ক্রয়াদেশ আসবে, তখন যেন আমাদের তা নেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকে।

পোশাক শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, দেশের বেশির ভাগ কারখানায় শ্রমিকদের অনেকটা বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতা দিতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলো থেকেও কোনো রকম সহযোগিতা মিলছে না। সরকারি তরফেও কোনো সহযোগিতার আশ্বাস নেই। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক মালিক ইতিমধ্যে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করেছেন। গড়ে কারখানায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার কর্ণফুলী সেতু এলাকার নিউ চর চাক্তাই সড়কের ডিপস অ্যাপারেলস লিমিটেডের তৈরি পোশাক কারখানার দুটি ইউনিট হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে মহাবিপাকে পড়েছেন ছয় শতাধিক শ্রমিক কর্মচারী। মালিক পক্ষ বলছে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাবে কারখানা দুটি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। কারণ গত কয়েক মাস ধরে কারখানা দুটিতে বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে তৈরি পোশাকের কোনো অর্ডার আসছিল না। তাতে কাজ কমে যায়। কর্তৃপক্ষ লোকসান দিয়েই কারখানা চালু রেখেছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার কারণে দেশের তৈরি পোশাক রফতানি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। অর্ডার কমেছে প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ। আর দেশে চলমান গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানি সংকটে উৎপাদন কমেছে আরও ২০ থেকে ৩০ শতাংশ।

চট্টগ্রামের বিজিএমইএর নেতারা বলছেন ডলার সঙ্কটের কারণে কাঁচামাল আমদানির এলসিও খোলা যাচ্ছে না। কেবল চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানায় আটকা পড়ে আছে ৩ হাজার কোটি টাকার রফতানি পোশাক। অর্ডার দিয়েও বিদেশি ক্রেতারা এসব পোশাক নিচ্ছেন না। এ অবস্থায় গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির এই খাত।

নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম  বলেন, ক্রয়াদেশের অভাবে তার নিজের কারখানার উত্পাদনসক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছেন। অর্ডার কমে গেছে ৩০ শতাংশ। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে গত দুই মাসে ১৫ শতাংশ শ্রমিককে বাদ দিতে হয়েছে। চলমান সংকটে গত দুই মাসে কিছু কারখানা ৫ থেকে ১০ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি জানান,  বড় সমস্যা ব্যাংক এলসি করছে না। কারণ ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় সময় মতো পরিশোধ হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সময়মতো এলসির দায় পরিশোধ না হলে এডি ব্যাঞ্চ লাইসেন্স বাতিলসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। এলসি যদি না খোলা হয় কারখানা খোলা রেখে কী লাভ। গত এক বছরে কমপক্ষে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এখন ব্যাংক এলসি না খুললে বেশির ভাগ কারখানাই বন্ধের ঝুঁকি আছে বলে জানান তিনি।

বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করা গেলেও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের দেশের জ্বালানি খাতকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষ করে দেশে তীব্র গ্যাসসংকট দেখা দেওয়ায় আমাদের টেক্সটাইল মিলগুলো দীর্ঘদিন ধরে কার্যত বন্ধ। ক্যাপটিভ পাওয়ার চালিয়ে আমরা যেসব শিল্প-কারখানা সচল রাখি, সেগুলোর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। গত ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে দেওয়া এক চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ক্রমাগত গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে মিলগুলোর উৎপাদনক্ষমতা বর্তমানে ৪০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার উচ্চ মূল্য, তীব্র ডলারসংকট, তৈরি সুতা ও কাপড়ের রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়া এবং রপ্তানি বিল না পাওয়ায় তুলাসহ অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি করার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রণোদনা প্যাকেজের আওয়তায় নতুন ঋণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মোহাম্মদ আলী খোকন।