বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
বাগেরহাট: ভরা মৌসুমে গলদা চিংড়ির দরপতনে লোকসানের মুখে পড়েছেন বাগেরহাটের চাষীরা। গত কয়েকদিনে আকার ও ওজন ভেদে বাগেরহাটে প্রতিকেজি গলদা চিংড়ির দাম কমেছে ১শ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত।
একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভাইরাস, নানা রোগ, বৈশ্বিক সংকট ও করোনা মহামারির পরে রপ্তানি কমে যাওয়ায় চিংড়ি নিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন চাষিরা। ফলে চিংড়ির উৎপাদন বাড়লেও লাভের মুখ দেখছেন না তারা। চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রণোদনা দেওয়া ও খাবারের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন চাষি ও জনপ্রতিনিধিরা।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাগেরহাটে এবার ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ি ঘের রয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে জেলায় চিংড়ির উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে, তার মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৩০ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে উৎপাদন হয় ৩৪ হাজার ৩৮ মেট্রিক টন, রপ্তানি হয় ২৪ হাজার ৪১৩ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে উৎপাদন বেড়ে দাড়ায় ৩৫ হাজার ৯৪২ মেট্রিক টন। যা থেকে রপ্তানি হয়েছিল ২৩ হাজার ৬৮ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৩৭ হাজার ৮৫৮ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছিল এই জেলায়। করোনা মহামারির কারণে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ২৩ হাজার ৩৬৭ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থ বছরে উৎপাদন হয় ৩৯ হাজার ৮৭১ মেট্রিক টন। রপ্তানি হয়েছিল ২৪ হাজার ১০৪ মেট্রিক টন।
অন্যদিকে এই সময়ে চিংড়ি মাছের খাবারের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এক বছর আগে প্রক্রিয়াজাতকরণ চিংড়ির খাবার অর্থ্যাৎ ফিস ফিডের দাম ছিল কোম্পানি ভেদে ২৫ কেজির বস্তা ৮শ থেকে ১৬শ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে তা কিনতে হচ্ছে ১২শ থেকে ২ হাজার টাকায়। এছাড়া এক বছর আগে ৩৫ কেজি ভূষি ১২শ টাকা বিক্রি হলেও, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৯শ টাকা, ডাল আগে ছিল ১৪শ টাকা বর্তমানে ২৮শ টাকা।
খাবারের দাম হুহু করে বাড়লেও চিংড়ি মাছের দাম বাড়েনি একটুও বরং কমেছে। এক বছর আগে ৫ থেকে ৬ পিসের প্রতি কেজি গলদা চিংড়ির দাম ছিল ১২শ থেকে ১৪শ টাকা, বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮শ থেকে ৯শ টাকা। এক বছর আগে ৯ থেকে ১২ পিসের প্রতি কেজি গলদা চিংড়ির দাম ছিল ১ হাজার থেকে ১১শ টাকা, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৬শ থেকে ৭শ টাকায়। এর থেকে ছোট ১৩ থেকে ২০ পিসে কেজির গলদা আগে বিক্রি হত ৪শ থেকে ৬শ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৩শ থেকে ৪শ টাকায়। মাছ বিক্রয়যোগ্য হওয়ার সময় এক সঙ্গে দাম কমলে পথে বসতে হবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
ফকিরহাট উপজেলার কাকডাঙ্গা এলাকার চিংড়ি চাষী রুহুল আমিন বলেন, ১০ বছর ধরে চিংড়ি মাছ চাষ করি। কখনো লোকসানের মুখে পড়তে হয়নি। এবার খাবারের দাম এত বেড়েছে যে, প্রথম দিকেই মনে করেছিলাম সমস্যা হবে। আবার বিক্রির সময় হঠাৎ করে দাম কমে গেল। লোকসান ছাড়া এবার আর উপায় নেই।
একই গ্রামের আব্দুর রশীদ শেখ বলেন, গত বছর ১৬ কাঠা জমিতে চিংড়ি চাষ করে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। এবার দুই লাখ ২০ হাজার টাকা পুঁজি খাটিয়ে বর্তমান বাজার দরে ৭০ হাজার টাকা লোকসান হওয়ার শঙ্কা আছি।
৩ লাখ টাকা ব্যয় করে দুই বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করেছিলেন মোস্তফা কামাল। চিংড়ির খাবারের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় পুঁজি ওঠা নিয়ে আশঙ্কা করছেন তিনি। বলেন, যদি বাজার দর পরিবর্তন হয়, তাহলেও কম লোকসানে পড়তে হবে। বছরের শুরুতেই বাজার দর পড়ে যাওয়ায় বর্তমানে আমরা যারা প্রান্তিক চাষি তাদের চাষ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ফকিরহাটের ফলতিতা বাজারের মেসার্স পদ্মা মৎস্য আড়তের মালিক ওমর আলী বলেন, প্রকৃতপক্ষে চিংড়ি ব্যবসায় একটি অসাধু সিন্ডিকেট রয়েছে। যাদের কারসাজির কারণে ভরা মৌসুমে চিংড়ি চাষিরা মাছ বিক্রির সময় ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এই সিন্ডিকেট ছাড়া যদি সরাসরি কোম্পানিতে মাছ বিক্রি করা যায়, তাহলে চাষিরা লাভবান হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন যাতে সরাসরি কোম্পানিগুলো চাষিদের কাছ থেকে মাছ কেনে, তাহলে তারা বেঁচে যাবে।
মেহেদী হাসান নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, অসাধু ফরিয়াদের কারণে চিংড়ি দাম কমে যায়। তারা নিয়ে মজুদ করেন। আবার নানা কারসাজি করে। এজন্য চাষীরা লোকসানে পড়েন। এভাবে চলতে থাকলে চিংড়ি চাষ শেষ হয়ে যাবে।
মূলঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিটলার গোলদার বলেন, বাগেরহাট চিংড়ি চাষের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু মাছের খাবারের দাম ও মাছের দামের পার্থ্যক্যের কারণে চাষিরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারিয়েছে ফেলছেন। চিংড়ি শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে চাষিদেরকে প্রণোদনাসহ খাবারের দাম কমাতে হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, নানা সমস্যার মধ্যে বাগেরহাটে চিংড়ি উৎপাদন কমেনি, বরং দিন দিন বাড়ছে। তবে দাম কম হওয়ায় কিছুটা বিপাকে রয়েছে চাষিরা। এজন্য কোম্পানি ও চাষিদের মাঝে থাকা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে মাছ কিনতে কোম্পানিগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এছাড়াও দেশের বাইরে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য মৎস্য বিভাগ কাজ করছে।