‘পামির’- তিন অক্ষরের এই শব্দটির সঠিক অর্থ আজও ধোঁয়াশা, যেমন ধোঁয়াশা রয়েছে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য নিয়ে। তবে বিখ্যাত এই ভৌগোলিক নামটি নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেউই এর বুৎপত্তিগত অর্থ সম্পর্কে একমত হতে পারেননি আজও। তবে মোটামোটি সবাইই স্বীকার করে নিয়েছেন পামির শব্দটি এতটাই প্রাচীন যে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞান দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব।
যতদূর জানা যায় ‘পামির’-শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বিখ্যাত চাইনিজ পরিব্রাজক ও ভূ-পর্যটক হুয়েন সাং। তিনি সপ্তম শতাব্দীতে কোনো এক কূটনৈতিক কাজে আমু দরিয়া নদীর উজানের অঞ্চল ভ্রমণের সময় তার নিজস্ব এক নোটে জায়গার নামের স্থানে লিখে রেখেছিলেন,
পো-মি-লো দেশটি দুটি তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণীর মধ্যবর্তী অংশে প্রসারিত। এখানে শুধু হিম ও হাওয়ার রাজত্ব চলে, এই অঞ্চলের মাটি বেশ লবণাক্ত এবং পাথুরে; যা বছরের অধিকাংশ সময়ই বরফাবৃত থাকে।
মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এই পামির আবার মালভূমিও, যাকে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়। আর মালভূমি বলতে বোঝায় এক বা একাধিক পাহাড়ের চূড়ায় সৃষ্টি হওয়া সমতল এক অঞ্চলকে,যা আমাদের পৃথিবীর বিশেষ এক ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যকেই মূলত ইঙ্গিত করে। এটিকে অনেক ক্ষেত্রে টেবিল ল্যান্ড হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়, কারণ এর ওপরের দিকটা কিছুটা সমতল এবং চারিদিকে খাড়া ঢালযুক্ত।
পামির অঞ্চলটি মূলত এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের ধারক হিসেবে বেশ সমৃদ্ধ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অঞ্চলটির গড় উচ্চতা প্রায় ১৬,০০০ ফুট। এই অঞ্চলটি মূলত বিভিন্ন উঁচু পর্বতের মিলনস্থল। বর্তমানে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটি বিশ্ববাসীর কাছে আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে এর ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে।
পামিরকে ‘পৃথিবীর ছাদ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, এর কারণ হলো পামির অঞ্চলটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ কয়েকটি পর্বতশ্রেণির সম্বন্বয়ে গঠিত, যেগুলো উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, কিরগিজস্তান, তিব্বত, চীন এবং পাকিস্তানের কিছু অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। তবে এর সিংহভাগই পড়েছে উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের সীমান্তে।
পামিরের দক্ষিণ-পূর্ব পাশেই অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সড়ক চায়না-কারাকোরাম হাইওয়ে। এছাড়া একই অঞ্চল ঘিরে অবস্থিত পামির হাইওয়েও, যেটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম উঁচু সড়ক, যার অবস্থান তাজিকিস্তানের দুশানবে থেকে কিরগিজস্তানের ওশ শহর অবধি। সাম্প্রতিক কালের এক জরিপে দেখা যায়, পামিরকে ঘিরে তৈরি হওয়া এই দুটি পথই বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গম সড়ক পথগুগুলোর মাঝে অন্যতম।
তবে, এখানকার অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গ্লেসিয়ার, হ্রদ এবং দূর্গম পাহাড়ি গিরিপথ অঞ্চলটিকে ক্রমেই রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। প্রতি বছর স্বল্প সময়ের জন্য অঞ্চলটিতে গ্রীষ্নকাল থাকে, আর বছরের অধিকাংশ সময়তেই অঞ্চলটি তুষারে ঢাকা থাকে। পামির অঞ্চলে বছরে গড়ে প্রায় ছয় ইঞ্চি তুষারপাত হয়। আর গ্রীষ্নে পামিরের বিস্তৃণ অঞ্চল ঘাসে ঢাকা থাকে, এই সময়টায় স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের নিজ নিজ গবাদিপশু পালন ও চাষবাষে বিশেষ মনোযোগ দেয়।
কারণ এটিই এই অঞ্চলের লোকেদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায় এবং বছরের বাকিটা সময়ে তাদের পশুপালন বা চাষাবাদের সেরকম কোনো সুযোগ থাকে না। তাছাড়া, এখানকার ভূমির গঠন প্রকৃতিও পৃথিবীর অন্য সকল অঞ্চল থেকে বেশ আলাদা, তাইতো অঞ্চলটি তার নাটকীয় ভূ-আকৃতির জন্যও বিখ্যাত। যেখানে রয়েছে একাধিক সুউচ্চ শৃঙ্গ যেগুলো বছরের পর বছর পর্বত আরোহীদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছে টানে।
সম্প্রতি পামির মালভূমির পশ্চিম প্রান্তে বেশ কয়েকটি কয়লার খনি আবিষ্কার করা হয়েছে, যেগুলো এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়া গত শতকের ৮০ এর দশকে এখানে ক্লিনোহিউমাইট নামক এক ধরনের রত্ন পাথরেরও সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এখানকার বিখ্যাত ইসমাইল সোমনি পিক যেটি পূর্ব কমিউনিজম পিক নামেও পরিচিত, এটি এখানকার সর্বোচ্চ চূড়া।
তাছাড়া, এখানকার অনান্য চূড়াগুলোও ৭০০০ মিটার বা ২৩,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতার হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর এই ভূ-ভাগের যতগুলো শৃঙ্গ রয়েছে এর সবগুলোই উচ্চতার দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ৫০০০ মিটারের অধিক। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত দানবীয় এই শৃঙ্গগুলো তাদের দুর্গমতা এবং বিরূপ আবহাওয়ার জন্য বেশ পরিচিত। এই অঞ্চলের বিখ্যাত কিছু শৃঙ্গ হলো: ইসমাইল সোমনি, জেঙ্গিশ চোকুসু, ইবনে সিনা বা লেনিন পিক, ইউহিন, কর্জেনেভস্কায়া, খান তেংরি, আলতাই ও তিয়েন শান ইত্যাদি।
পাহাড় আর হিমবাহে ঘেরা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বেশ পুরনো। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এবং সবচেয়ে বড় এই মালভূমিতে বসবাসরত পামিরি জনগণের মতো এখানকার অনান্য আদি জাতি গোষ্ঠীগুলোই এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূল ধারক। এখানে বসবাসরত সম্প্রদায়গুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য এবং ভাষা সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ওয়াখি, শুঘনি এবং বারতাঙ্গি পামির সংস্কৃতির ভিত্তি গঠনকারী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম।
তাছাড়া, পামির অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্য, ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোগস্থল। প্রাচীন সিল্ক রোড বরাবর এর কৌশলগত অবস্থান হওয়ায় বর্তমানে অঞ্চলটি চীন থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ব্যবসায়ী এবং ভ্রমণকারীদের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তবে নানামুখী প্রতিকূলতা এবং স্থিতিস্থাপকতায় ঘেরা পামির অঞ্চলের জনগণের জীবন কখনও সহজ ছিল না। এই অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীই বহু ঘাত- প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ তাদের অস্তিত্ব ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, পামির অঞ্চলটি তার অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে পর্বত আরোহীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাছাড়া, অধরা তুষার চিতাবাঘসহ এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণী, অঞ্চলটিকে ইকোট্যুরিজমের হটস্পটে রূপান্তরিত করেছে। যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুউচ্চ পাহাড় দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই অঞ্চলের সম্প্রদায়গুলো তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র অভ্যাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমগ্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে।
পামির অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং আলোচিত অংশগুলোর মধ্যে একটি হলো ওয়াখান করিডোর। যেটি তাজিকিস্তানকে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। প্রাচীন এই ঐতিহাসিক করিডোরটি ছিল সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ, যা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কে ক্রমেই সহজতর করতে সক্ষম হয়েছিল। এই রাস্তাটি চীনের প্রাচীন রাজধানী শহর জিয়ান থেকে পামির পর্বতমালার উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়ে তৎকালীন জিনজিয়ান রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর কাশগড়কে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
পামির নিয়ে বলতে গেলে যেটি বলতেই হয়, অঞ্চলটির জীব ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের স্থিতিস্থাপকতা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রমাণ হিসেবে আজও ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে কালো থাবা তা কিন্তু এখানটায়ও ক্রমেই পড়তে শুরু করেছে।
পৃথিবীর বড় বড় গ্লেসিয়ারগুলোর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই পামির ও এর আশেপাশের কারাকোরাম রেঞ্জ অঞ্চলে অবস্থিত, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ইতিমধ্যেই গলতে শুরু করেছে, যা এই অঞ্চল তো বটেই সমগ্র বিশ্বের জন্যও এক ধরনের অশনি সংকেত।
-সংকলিত