Home অন্যান্য নজরবন্দি

নজরবন্দি

 গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

কম্পিউটরের স্ক্রিনের সামনে চারটে ক্যামেরায় বাইরের গতানুগতিক জীবনের ছবি। সরের মতো ভোরের কুয়াশা চারপাশে। রাতে ডিউটি করে সাড়ে সাতটায় চলে গিয়েছে এএসআই চৌবে। সুগত ঢুকেছে সাতটা পাঁচ নাগাদ। তারপর থেকে একবারের জন্যও চোখ সরায়নি স্ক্রিন থেকে।
বিহার-ঝাড়খণ্ড সীমানায় নজরদারির কাজটা ক্রমেই জটিল হচ্ছে। ঝাড়খণ্ড, বিহার এমনকি উত্তরপ্রদেশ থেকে কখন যে কোন লোকটা, কী মতলবে বরাকর হয়ে বাংলায় ঢুকে পড়ছে তার আগাম খবর পাওয়া ক্রমেই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। দিনদুয়েক আগে দিল্লি থেকে বড়বাবুর কাছে ফোনে জানানো হয়েছে, এই রুটটাকে সুপার সেনসিটিভ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তিন নম্বর ক্যামেরায় বরাকর বাসস্ট্যান্ড। একটা বাস এসে দাঁড়াল। খানকয়েক দেহাতি পুরুষ। কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে একটা পরিবার। লোকটার এক হাতে মোবাইল, অন্য হাতে ফুট তিনেকের এক খুদে। লাল জামা, নীল হাফ প্যান্ট। নাকে সর্দি, খালি পা। বাচ্চাটাকে টানতে টানতে নামাচ্ছে লোকটা। সুগত ভুরু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করে। ছেলেটা কি কাঁদছে নাকি? ছেলেধরা নয়তো? না, ওই তো মা’টাও নামছে। কোলে একটা, পেটেও আর একজন এসে গিয়েছে।
পিছনে একটা কম বয়সি ছোকরা। চিমড়ে চেহারা, চোখে সানগ্লাস। হাতে ওটা কী? কাগজে মোড়া বোতল মনে হচ্ছে। সুগত চোখ সরায় না। বাসে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছিল। হয়তো লছিপুরে কারও ঘরে রাত কাটিয়েছে। মাসপয়লায় হাতে টাকা এসেছে। এখনও রাত্রের খেউড়ি কাটেনি। বাস কনডাক্টরের সঙ্গে ভালো দোস্তি দেখা যাচ্ছে। তার মানে এখানকারই মাল। এদের নিয়ে চিন্তার বিশেষ কারণ নেই। কানের গোড়ায় একটা কষিয়ে দিলেই হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলবে। তবু সাবধানের মার নেই। একবার পরে জেনে নিতে হবে, ছোঁড়া থাকে কোথায়। ট্রেনিংয়ের সময় বারবার বলে দেওয়া হয়েছে, বিন্দুমাত্র অসাবধান হওয়া যাবে না, মুহূর্তের মধ্যে ভয়ংকর বিপদ ঘটে যেতে পারে।
লালবাজার থেকে ওর সঙ্গে আরও ছ’জনকে দিল্লি পাঠানো হয়েছিল স্পেশাল ট্রেনিংয়ের জন্য। প্রকৃতই ঘামঝরানো ট্রেনিং। বম্ব ডিসপোজাল থেকে কমব্যাট, এমনকি, জঙ্গিদের সঙ্গে প্রাথমিক আচরণ কীভাবে করতে হবে, সবকিছু। আস্ত মহাভারতের মতো ঢাউস একটা ম্যানুয়াল দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গিদের চালচলন থেকে আইসিসের ইতিহাস, কী নেই তাতে। ছ’মাসের ট্রেনিংয়ে সেটা মুখস্থ করা সবচেয়ে কঠিন টাস্ক ছিল সুগতর কাছে। ট্রেনিংয়ের প্রথম দিকেই এসেছিলেন ডাকসাইটে এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট, অভিজ্ঞ অফিসার মিঃ রাও। তাঁর কথাগুলো মনে ধরেছিল সুগতর। তাঁর একটাই সাফ বক্তব্য ছিল, কাউকে ছাড়া চলবে না। প্রতিটি মানুষকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। জঙ্গিদের সমূলে বিনাশ করতে সরকারের কাছে এর বাইরে আর কোনও রাস্তা নেই।
ন’টা বেজে গেল। দু’নম্বর ক্যামেরায় বরাকর স্টেশনের আড়মোড়া ভাঙার ছবি। এক ভদ্রলোক ইতিউতি তাকাচ্ছেন। জামার বুকপকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বার করলেন। পাতা ওলটালেন। আবার পকেটে ভরলেন। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী দেখছেন বুঝবার চেষ্টা করে সুগত। নেহাত সাদামাঠা চেহারা। কী পরে আছেন, টি-শার্ট নাকি জামা? ঠাহর করে মনে হচ্ছে আকাশি রংয়ের টি-শার্ট, কালো প্যান্ট। বয়স কত হবে? পঞ্চান্ন থেকে বড়জোর ষাট, তার বেশি তো মনে হয় না। আবার জামার পকেটে হাত ঢোকালেন। নোটবইটা ফের বার করলেন। হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে নেহাত ছাপোষা ভদ্রলোক। হয়তো কারও জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
কম্পিউটরের স্ক্রিনের সামনে ঝুঁকে থাকতে থাকতে সুগতর কোমরে ব্যথা হয়ে গেল। জিনিসগুলো কিনতে একবার মোড়ের দোকানে যাওয়ার দরকার ছিল। ছুটু এলেই বেরোবে। ছুটু এলে নিশ্চিন্তও লাগে অনেকটা। ছ’বছর বয়স থেকে অপরাধের জগতে বিচরণ ছুটুর। সুগত জয়েন করার পরের দিন বড়বাবু ছুটুকে ডেকে সুগতর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বলেছিলেন, ‘বাপের শিক্ষায় কী হাত বানিয়েছে এই ছোকরা, না দেখলে বিশ্বাস করবে না সুগত। একেবারে মাখন। পলক ফেলার আগেই পকেট হালকা করে দেবে।’ বহুবার ধরা পড়েছে আগে। বেধড়ক মারও খেয়েছে, কখনও পাবলিকের কখনও পুলিশের। অবশেষে সে জগৎ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন থানার পয়লা নম্বর খোঁচড় মানে ইনফর্মার। তার ওপর এখন তো রাজার চাকরি। বড়কর্তাদের দৌলতে আর লোকাল কাউন্সিলারের কৃপায় মাস গেলে হাজার পনেরোর বেশি রোজগার, তার সঙ্গে ইজ্জতের চাকরি। সিভিক ভলান্টিয়ার। ছুটুর চোখটাই খুব সাংঘাতিক। যে কোনও অপরাধীর হাঁটা, চলা, কথা বলা থেকে বুঝে যায় কার পেটে কত কিলো শয়তানি জমা আছে।
ন’টা বাজতে চলল।
এক নম্বর ক্যামেরায় নিয়ামতপুর মোড়। সেখানে ভিড় বাড়ছে। ক্যামেরা জুম করে সুগত। মেয়েটার বুকটা অত বড় লাগছে কেন? ভিতরে কিছু ভরা আছে নাকি! লছিপুরের যৌনকর্মীদের ব্যবসা মার খাওয়ার পর এখন মেয়েগুলো বুকের মধ্যে পাতা এনে বিক্রি করে। একদিন তো একটা মেয়ের বুক থেকে কেজিখানেক গাঁজা মিলেছিল। সবচেয়ে বদ ওই নেশাড়ুগুলো, শালারা এদের কাছেই মাল কিনবে। মেয়েটার বুকের ওপর থেকে চোখ সরায় না সুগত। এই কাজটা পেশার তাগিদে করতে হচ্ছে সুগতকে। কাজটার একটা থ্রিল আছে অবশ্য।
চার নম্বর ক্যামেরাটা সরাসরি চেকপোস্টের ওপর। লরির বিশাল লাইন। এখানে ভালো কামাই হয় কনস্টেবলদের। সিসিটিভির দৌরাত্ম্যেও সেটা খুব একটা কমেনি। আরে দু’নম্বর ক্যামেরার সামনে ভদ্রলোক কোথায় গেলেন? বেশ কিছু যাত্রী ঢুকছে, বেরোচ্ছে স্টেশনের গেট দিয়ে। কোনও ট্রেন এসেছে হয়তো। ওই তো পিছন দিকে এক বিশাল পেটমোটা যাত্রীর পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ভদ্রলোকের কাঁধে একটা ঝোলা রয়েছে, আগে সেটা লক্ষ করেনি সুগত। ছুটু এসে গিয়েছে।
-ভালো হয়েছে, ছুটু, তুই একটু কম্পিউটারের সামনে বোস। আমি মোড় থেকে ঘুরে আসছি।
ছুটু ডেস্কটপের সামনে বসে পড়ে। সুগত বাইরে গিয়ে মোটরবাইকে স্টার্ট দিল। লিস্টের মালগুলো সন্ধের মধ্যে ডিএসপি সাহেবের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। এই ডিএসপি সাহেবের কোনও লজ্জা নেই, ভাবে সুগত। একজন জুনিয়ার অফিসারকে দিয়ে মাল আনাবে আবার টাকা দিতেও টালবাহানা করবে। তবে ট্রেনিংয়ের পর থেকে সুগতর ইজ্জতটা বেড়ে গিয়েছে। এখন সুগত আর ঠিক থানার আন্ডারে নেই। সে এখন সরাসরি কমিশনারেটে রিপোর্ট করে। জিনিসপত্র কিনে সবে ডিএসপির বাড়িতে সবে পৌঁছেছে, মোবাইলটা বাজল। সুগতর ভুরু কুঁচকে যায়, থানা থেকে ফোন।
-হ্যালো
-সার আমি ছুটু।
-কী হল?
-সার একবার চট করে আসতে পারবেন?
-কেন? এই তো বলে এলাম খানিক পরে আসছি।
-না, সার একবার এলে খুব ভালো হয়। আর্জেন্ট সার।
-বাপরে, আবার আর্জেন্ট?
-হ্যাঁ, সার। কটাক্ষ গায়ে মাখে না ছুটু। তাহলে সত্যিই আর্জেন্ট। তড়িঘড়ি মালগুলো সাহেবের বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই বাইক ঘোরায় সুগত। মিনিট দশেকের মধ্যেই ঢুকে পড়ল থানা চত্বরে। থানার বাইরে কয়েকজনের ভিড়। কোনও ঝাড়পিটের কেস হবে হয়তো। এসব রোজ লেগেই আছে। কোনওদিকে না তাকিয়ে হনহন করে থানার ভিতরে ঢুকে পড়ে সুগত।
-কী হয়েছে রে ছুটু?
-সার, একবার আসুন, এখানে দেখুন।
-কী দেখব?
-সার, এই লোকটাকে দেখেছেন?
-কোন লোকটা? ও, ওই ভদ্রলোক? হ্যাঁ, ওঁকে তো খানিক আগে দেখে গেলাম বরাকর স্টেশনের সামনে। এটা তো দেখছি নিয়ামতপুর মোড়ে। তখন তো এখানে ছিলেন না।
-সার, লোকটাকে তুলতে হবে মনে হচ্ছে।
-পাগলের মতো কথা বলিস না।
-না সার। সত্যি বলছি।
-কেন?
দেখুন সার, লোকটার পকেটটা দেখছেন, উঁচু হয়ে আছে?
-হ্যাঁ, দেখেছি। একটা নোটবই আছে।
-হ্যাঁ, ঠিকই, কিন্তু ওটা বার করে মাঝে মাঝেই চারপাশে তাকাচ্ছে। আর মোবাইলটা দেখছে। মানে সার, তার মানে কাউকে খুঁজছে। নোটবইয়ে তার নাম, ফোন নম্বর লেখা আছে। তখন থেকে সার এইরকম করে যাচ্ছে। কিন্তু কারও সঙ্গে কথা বলছে না কেন? কাউকে তো জিজ্ঞেস করতে পারে? করছে না সার। এই নিয়ামতপুর মোড়েই গত বছর একজন ধরা পড়েছিল।
-হুঁ। সেটাকে থানায় তুলে এনে কলকাতায় পাঠাতে হল। সেখান থেকে ওকে আবার এনআইএ নিজেদের হেপাজতে নিয়েছিল। সে মামলা এখনও চলছে। তুই তো চিন্তা ধরিয়ে দিলি।
-সার, এখুনি এই মালটাকে তুলুন সার।
-ভদ্রলোককে দেখে তো কিছু মনে হচ্ছে না ছুটু।
-দেখে আপনি কী বুঝবেন সার? দিনেরবেলায় নিজের বৌয়ের ছবি ওঠাবে আর রাতে সার মেয়েদের, ছাড়ুন‌ সার।  লোকটার মুখটা দেখুন সার ভালো করে। কাঁধের থলেটাতেও কিছু আছে সার।
-ঠিক আছে, তুই স্ক্রিনে লক্ষ রাখ। আমি বড়বাবুর সঙ্গে কথাটা বলে নিই।
সুগত মোবাইলে ধরে বড়বাবুকে। সমস্ত ঘটনা শুনে তিনি জানিয়ে দিলেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে থানায় আসছেন আর সুগতকে অবিলম্বে ইন্টারসেপ্ট করার নির্দেশ দিলেন। তবে খুব সাবধানে।
হ্যাঁ, সার। সে তো অবশ্যই।
-আর্মস থাকতে পারে ওর কাছে। তুমি একজন সিআইএসএফ আর দুজন কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে যাও। আমাদের এখানে এখন চারজন জওয়ান আছে। আমি তাদের একজনকে বলে দিচ্ছি। আমি কমিশনারেটেও জানিয়ে রাখছি। আর সিসিটিভিতে লক্ষ রাখতে হবে।
-ছুটু আছে সার।
-ঠিক আছে, তুমি বেরিয়ে যাও।
-ওকে সার।
নিয়ামতপুরে ভদ্রলোক এখনও একই বেঞ্চে বসে আছেন। সুগত ইশারায় অন্যদের জিপে বসে নজর রাখতে বলে। তবে সিআইএসএফ জওয়ানটি নেমে সুগতকে অল্প পিছনে অনুসরণ করতে থাকে। সুগতর বুকের মধ্যে ঢেউ উঠছে-নামছে। এটা হওয়া অবশ্য ভালো। ট্রেনিংয়ে বলা হয়েছে, এটার মানে অ্যাড্রিনালিন রাশ হচ্ছে। সুগত সরাসরি ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসে পড়ে।
-এক কাপ চা দে রে।
ভাঁড়ে করে চা নিতে গিয়েই খানিকটা চলকে পড়ে ভদ্রলোকের গায়ে। ভদ্রলোক চমকে ওঠেন। সুগত ‘সরি’ বলে মুখে অপ্রস্তুতের হাসি এনে সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছে দিতে যায়। ভদ্রলোক তার দিকে নিরীক্ষণ করে হঠাৎ বিড়বিড় করে বলে ওঠেন,
-কী হল গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?
-না, না, কিছু মনে করবেন না।
এবার ভদ্রলোক সুগতর মুখ ভালো করে নিরীক্ষণ করেন। তারপর হঠাৎ ফিশফিশ করে বলে ওঠেন
-কে মিজানুর পাঠিয়েছে?
-চমকে ওঠে সুগত। মিজানুর রহমান! দিল্লি থেকে থানাতে তার মাগশট আসার পর সুগতই তো থানার বোর্ডে লাগিয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকেছে মাসছয়েক আগে। তাহলে ছুটুর সন্দেহই কি ঠিক? মনের চাঞ্চল্য বিন্দুমাত্র প্রকাশ করতে দেওয়া যাবে না। সুগত স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করে।
-মিজানুরকে খুঁজছেন?
ভদ্রলোক বিড়বিড় করে কী যেন বলে ঘাড় নাড়েন। নোটবইটা বার করেন। পাশে বসে সুগত দেখতে পায়, সেখানে সুছাঁদ অক্ষরে লেখা, মিজানুর রহমান, কালকিনি উপজেলা, ঢাকা। তার নীচে আরও কয়েকটি নাম। সেগুলো পড়ার আগেই ভদ্রলোক নোটবই বন্ধ করে দেন।
-আমাকে মিজানুরই পাঠিয়েছে।
এই কথা শুনে ভদ্রলোক স্থির দৃষ্টিতে তাকান সুগতর দিকে।
-আপনি তো অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছেন কাকে পাঠিয়েছে মিজানুর, তাই না?
ভদ্রলোক উত্তর দেন না।
-মিজানুর আমাকেই পাঠিয়েছে। সকালেই আসার কথা ছিল। কয়েকটা কাজ সেরে আসতে আসতেই দেরি হয়ে গেল।
ভদ্রলোকের মুখে খানিক সন্দেহের ভাব ফুটে উঠছে। চোখদুটো চঞ্চল হয়ে উঠল। হঠাৎ কাঁধ থেকে ঝোলা থলের মধ্যে ডান হাতটা ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন। সুগত কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
-আপনার থলেতে কী আছে?
এই কথা শুনেই ভদ্রলোক ইস্পাত শীতল কণ্ঠে বলেন।
-না, না ওখানে হাত নয়। এটা মিজানুরের জন্য। মিজানুর আপনাকে পাঠিয়েছে, কিন্তু আপনাকে তো…
-আপনি আমাকে চেনেন না। আমাকে বলে দিয়েছে মিজানুর। কিন্তু এখন আপনি উঠুন। আর দেরি করবেন না।
সুগত বুঝেছে, বেশি ঘাঁটানো চলবে না।
-থলেটা আমাকে দেবেন?
-থলেতে হাত দেবেন না।
-না, না হাত দিচ্ছি না। চলুন।
সুগত বুঝে গিয়েছে, এ মাল বুঝে গিয়েছে, মিজানুর তাকে পাঠায়নি, আর তার পরিচয়টাও আন্দাজ করে নিয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে ইশারা করে ডেকে নেয় সঙ্গীদের। একটা ঘেরাটোপের মাঝে কার্যত বন্দি করা ফেলা হয় ভদ্রলোককে। যখন তাঁকে জিপে ওঠানো হল, তখন তাঁর মুখে আর একটিও কথা নেই। সম্ভবত বুঝে গিয়েছেন, এই মুহূর্তে কিছু না করাই সংগত। বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়িতে উঠে পড়েন। দ্রুততার সঙ্গে প্রাথমিক কাজটা হয়ে যাওয়ায় হাঁফ ছাড়ে সুগত, কিন্তু থলেটা থেকে চোখ সরায় না। থলেটা কোলের ওপর ধরে রেখেছেন। ঠোঁটের কোণে কি একটা হাসি খেলা করছে? সুগতর মনে হয়, এটা আসলে উপেক্ষার হাসি, এরা এতটাই কঠিন হতে পারে যে এরা জানে এদের ভিতর থেকে একটি কথা বার করা যাবে না। আর সেই কারণেই এরা এতটা এরকম কঠিন হতে পারে।
বেলা এগারোটা নাগাদ যখন সুগত থানায় ঢুকল তখন প্রায় সব অফিসার চলে এসেছেন। গত রাত্তিরে একটা চোরকে ধরে লক আপে ঢোকানো হয়েছে। তারই বাড়ির লোকজন এসে থানা চত্বরে ভিড় করেছে। এ ব্যাপারে সুগতর মাথাব্যথা নেই। সরাসরি বড়বাবুর চেম্বারে গিয়ে হাজির হয় সুগত। ভদ্রলোককে একটা চেয়ারে বসতে বলে সামনে বসা বড়বাবুকে ফোনে একটা মেসেজ করে, ইশারায় সেটা দেখতে বলে। বড়বাবুর মোবাইল স্ক্রিনে মেসেজ ফুটে ওঠে- হাইলি সাসপিশাস। এরপর ঘটনা ঘটতে থাকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। আধ ঘণ্টার মধ্যে বাকি জওয়ানদের নিয়ে ভদ্রলোককে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আসানসোলে কমিশনারেটে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি সারা হয়ে যায়। ভদ্রলোক চুপ। শুধু চারপাশটা দেখে চলেছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
সুগত কমিশনারকে ফোনে যা জানাল তার সারমর্ম হচ্ছে, লোকটি অতীব সেয়ানা। একটা কথারও উত্তর দিচ্ছে না। সকাল থেকে সমস্ত এলাকা রেকি করেছে। থলেতে হাত দিতে দেয়নি। সেখানে কিছু একটা সন্দেহজনক বস্তু রয়েছে তা বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে। সেটা কী তা জানা যাচ্ছে না। তবে আগ্নেয়াস্ত্র হওয়া আশ্চর্য নয়। নোটবইটা অবশ্য পুলিশের হাতে এসেছে। সেখানে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজনের নাম, ঠিকানা লেখা। সাংকেতিক ভাষায় কিছু সমীকরণও রয়েছে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে কমিশনার স্বয়ং ‘প্যাকেজ ডেসপ্যাচ’ করার নির্দেশ দিলেন। অভিযুক্তকে অবিলম্বে পাঠিয়ে দিতে হবে আসানসোল কমিশনারেটে। ইতিমধ্যে এই সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে দণ্ড সংহিতা অনুসারে এফআইআর দায়ের করা হয়ে গিয়েছে। একটা মেমো করে দিয়েছেন বড়বাবু। সেখানে সকাল থেকে সুগত যা দেখেছে এবং যা করেছে তার বিবরণ আছে। সুগতর মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা হচ্ছে। কেসটা ভালোভাবে উতরে গেলে প্রোমোশন না হলেও, সিআরটা দারুণ হয়ে যাবে।
চূড়ান্ত নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আসানসোলে কমিশনারেটে নিয়ে যাওয়া হল অভিযুক্তকে। সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তকে একটি ফাঁকা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। কলকাতা থেকে এনআইএ অফিসার সহ দুজন টেররিস্ট এক্সপার্ট এসে পড়লেন বিকালের মধ্যে। সাবজেক্টের ওপর কোনওরকম চাপ সৃষ্টি করা চলবে না। তাহলে তার কাছ থেকে কিছুই বার করা যাবে না। এখনই থলেটা কাড়বার দরকার নেই, বলে পরামর্শ দিয়েছেন এনআইএ অফিসার গৌরব ঝা। কলকাতা থেকে বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এলে তবেই থলেটা নেওয়ার কথা ভাবা হবে। ওর ভিতরে যদি কিছু টাইমার জাতীয় গ্যাজেট থাকে তাহলে অতি সতর্কতার সঙ্গে ডিল করতে হবে।
এদিকে আসা ইস্তক মুখে সেই যে কুলুপ এঁটেছে লোকটা তা আর খোলেনি। তাই নিয়ে কমিশনার বেশ চিন্তিত। ইন্টারোগেশন রুমে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করলেন মিঃ ঝা।
-আপনার নাম কী?
-উত্তর নেই।
-কোথা থেকে এসেছেন?
-উত্তর নেই।
-মিজানুর কে হয় আপনার?
ফের চাঞ্চল্য দেখা দেয় অভিযুক্তের শরীরে। কিন্তু উত্তর নেই।
-মিজানুরকে আপনার খবর দেওয়া হবে বলেই আপনার কাছে তার ফোন নম্বর চাওয়া হচ্ছে।
-উত্তর নেই। তবে মুখে তীব্র বিরক্তির ছাপ দেখতে পেলেন অফিসাররা।
মিজানুর ছাড়া আর কার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল আপনার? কী হল কিছু বলুন? দেখুন বলতে তো আপনাকে হবেই। এখনই বলে দিলে আপনার হ্যারাসমেন্ট কম হবে। নাহলে অনেক বেশি টানাহ্যাঁচড়া। আর কার কার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে আপনার? মিজানুরের সঙ্গে আর কে ছিল আপনার সঙ্গে? ভুরু কুঁচকে যায় ভদ্রলোকের। কী হল কানে যাচ্ছে না? মিজানুর ছাড়া আর কে কে ছিল আপনার সঙ্গে? এক প্রশ্ন শুনে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে ভদ্রলোকের মুখে। এবার আকস্মিকভাবেই ভদ্রলোক বলে ওঠেন,
-হাবিবুর, হাবিবুর
-হাবিবুর, বেশ, বেশ।
-আর রফিক।
সমস্ত কথাই রেকর্ড করে চলেছে জুনিয়ার কমব্যাট অফিসার প্রমোদ তেওয়ারি।
-আর?
-উত্তর নেই।
-কী হল, শুনতে পাচ্ছেন না? আর কে ছিল?
-উত্তর নেই।
-জল খাবেন?
-উত্তর নেই।
এই শোন উত্তর দিবি না কি চুপ করে থাকবি? এসব চালাকি বহুত জানি আমি। তোর ওই মিজানুরকে  ধরে এনে তোর সামনেই…। চিৎকার করে ওঠে প্রমোদ। পাশের সিনিয়ার অফিসার তাকে চুপ করান।
-আরে, ওইভাবে কেন কথা বলছ? বলবে, সব বলবে। কত ঘুঘু দেখলাম। দেখি তো এবার তোমার থলেটা দাও দেখি।
ভদ্রলোকের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। থলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ান। চিৎকার করে বাঁ হাত দিয়ে টেবিলের ওপর একটা ঘুসি মারেন।
চু…প। মিজানুরের নামে একটাও কথা নয়। থলেতে হাত দেবে না। মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। থলে থেকে চকিতে বেরিয়ে আসে একটা চকচকে পিস্তল। সেটা তাক করা থাকে জুনিয়ার অফিসারের দিকে।
সকলে চুপ করে যায়। প্রত্যেকের চোখেমুখে আতঙ্ক খেলা করে। সিনিয়ার অফিসার ইশারায় প্রত্যেককে ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরোতে বলেন। সবাই বেরিয়ে যান। ভদ্রলোক চেয়ারে বসে পড়েন। তাঁর সারা শরীর কাঁপছে।
দিল্লি থেকে ফোন আসে রাত দেড়টা নাগাদ। প্যাকেজ টু বি ডেসপ্যাচড টু এনআইএ হেডকোয়াটার্স দিল্লি। ভোরবেলার ফ্লাইট। আসানসোল থেকে রাত আড়াইটে নাগাদ অভিযুক্তকে নিয়ে কড়া নিরাপত্তায় গাড়ি রওনা হয়ে যায়। টিমের সঙ্গে সুগতকে সঙ্গে নেওয়া হয়।
পরের দিন ভোর সাড়ে পাঁচটা। অন্ধকার সরিয়ে ঘষা কাচের সকাল ঘিরে ধরেছে শিল্প শহরকে। বরাকর থানা প্রাঙ্গণ শুনসান। সিসিটিভির সামনে এক হাবিলদার। এক জুনিয়ার অফিসার পাশের চেয়ারে বসে মোবাইলে গেম খেলছেন আর মাঝে মাঝেই হাবিলদারটিকে বলছেন যাতে স্ক্রিন থেকে চোখ না সরায়।
উশকোখুশকো চেহারা, সম্ভ্রান্ত এক যুবক উদভ্রান্তের মতো হুড়মুড়িয়ে থানায় ঢুকেই কাতরভাবে অফিসারের কাছে অনুনয় করেন।
-সার, সার
-কী চাই?
-সার, কাল আমরা পরিবারের সকলে এসেছিলাম মাইথন বেড়াতে। কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে পুজো দেওয়ার ছিল সকালে। কিন্তু সার আমাদের বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
মোবাইল থেকে মুখ না সরিয়েই অফিসার জিজ্ঞাসা করেন,
-বয়স কত?
-এই ধরুন পঞ্চান্ন-ষাট হবে।
মোবাইল বন্ধ করে আগন্তুকের দিকে ঘুমজড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করেন,
-কী হয়েছিল?
-মানে, সার, আমার বাবা কয়েকবছর ধরে অ্যালজাইমার্সে ভুগছেন, তার মধ্যে ডিমেনশিয়া। সবাইকে চিনতেও পারেন না। শুধু মাঝে মাঝে সেই ছোটবেলার কথা বলতে থাকেন আজকাল। বাবা ক্লাস ফোর-এ পড়ার সময় আমাদের দাদু ঢাকা থেকে বাবা আর পিসিকে নিয়ে চলে এসেছিলেন। মাসছয়েক ধরে বাবা শুধু সেই ছোটবেলার পাড়ার বন্ধু মিজানুর, হাবিবুল আর কার কার যেন নাম করেন।
অফিসার ঘুমজড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করেন,
-আসল কথাটা বলুন।
– হ্যাঁ, বলছি সার। দিনকয়েক আগে আমি আমার ছেলের জন্য একটা খেলনা পিস্তল কিনে আনলাম। সেটা দেখেই বাবা হঠাৎ বলে উঠল, ওটা নাকি তাঁর সেই ছোবেলার বন্ধু মিজানুরের। তারপর ওটাকে একটা থলের মধ্যে ঢুকিয়ে সেই যে টেনে ধরে রাখলেন, তারপর থেকে আর নেওয়া যায়নি। এমনকি, চান, খাওয়াদাওয়ার সময়েও নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। কেবল বলছেন, মিজানুরের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন, সেটা ফেরত দিতে হবে। কাল আমাদের সঙ্গে এখানে নিয়ে এসেছিলাম, এখানে পুজো দিয়ে আজ ফিরে গিয়ে কলকাতায় একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাব বলে কথা ছিল। আজ সকাল থেকে আমরা গেস্ট হাউসে আর বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না। হন্যে হয়ে ঘুরছি সার।
জুনিয়ার অফিসারটি একটা বিরাট হাই তুলে বলেন।
-একটা কমপ্লেন লিখুন। এখন তো কিছু করার নেই। বাইরে সকলে মিলে খোঁজাখুঁজি করুন। চব্বিশ ঘণ্টা যেতে দিন।
-অনেক খুঁজেছি সার। আমার স্ত্রী আর ড্রাইভার ঝাড়খণ্ডের দিকে খুঁজতে গিয়েছে। একটু আপনারা দেখুন না সার।
অফিসারটির ভুরু কুঁচকে যায়।
-নিজেদের বাবাকে ঠিক রাখতে পারেন না। আর আমাদের খুঁজে দিতে হবে। বললাম তো কমপ্লেন লিখুন। বাইরের বেঞ্চে বসুন। বড়বাবুকে আসতে দিন। তারপর যা হওয়ার হবে।
ধীর পায়ে থানার বাইরে এসে দাঁড়ায় নিখিল। ঘুমের ঘোর চোখে নিয়ে সকাল হচ্ছে। নরম রোদ্দুর তেরছাভাবে এসে পড়ে বেঞ্চের ওপর।

সৌজন্য: উত্তরবঙ্গ সংবাদ