Home First Lead অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে নিজস্ব বাজার তৈরি বড় চ্যালেঞ্জ

অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে নিজস্ব বাজার তৈরি বড় চ্যালেঞ্জ

‘অটোমোবাইল শিল্পের উন্নয়ন : বর্তমান বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনার

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি

ঢাকা: টোমোবাইল শিল্পের উন্নয়নে সঠিক নীতি সহায়তা, প্রণোদনা ও কর সুবিধা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। রোববার (১৮ এপ্রিল) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘অটোমোবাইল শিল্পের উন্নয়ন : বর্তমান বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা এমন মন্তব্য করেন।

ওয়েবিনারে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নায়োকি ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ও সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।

ওয়েবিনারের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘আমাদের অটোমোবাইল শিল্পে মূলত আমদানি নির্ভর রিকন্ডিশন্ড গাড়ির প্রধান্যই বেশি। তবে জাপান, চীন ও ভারত থেকে কিছু নতুন গাড়িও আমদানি করা হয়, যার সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে দেশের এ শিল্পখাত প্রতিবছর গড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও, বিআরটিএ তথ্য মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোটর ভেহিক্যালের নিবন্ধন কমেছে প্রায় ২৪ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালায় অভাব, সহায়ক শুল্ক কাঠামো না থাকা, স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত কাঁচামালের যোগান না থাকা, দক্ষ মানবসম্পদ ও বেকওয়ার্ড লিংকেজ খাতের অনুপস্থিতির কারণে আমাদের অটোমোবাইল শিল্পে কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।’

তিনি উল্লেখ করেন, এখাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য শিল্পমন্ত্রণালয় ১০ বছর মেয়াদি ‘বাংলাদেশ অটোমোবাইল সেক্টর রোডম্যাপ ২০২১-২২’ এবং ‘অটোমোবাইল-ম্যানুফেকচারিং ডেভেলপমেন্ট পলিসি’-এর খসড়া প্রস্তুত করেছে, যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে চূড়ান্তকরণ করা একান্ত অপরিহার্য। পাশাপাশি গাড়ি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ তৈরিতে স্থানীয় শিল্পের বিকাশের জন্য যৌথ বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, কমপক্ষে ৫-১০ বছর মেয়াদি সহায়ক শুল্ক নীতিমালা প্রদান, প্রবাসী বাংলাদেশিদের এখাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য ৫ বছরের কর অব্যাহতি প্রদান এবং এখাতের গবেষণা কার্যক্রমকে উৎসাহিত ও প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিতকল্পে ‘জাতীয় অটোমোবাইল কাউন্সিল’ এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে ‘জাতীয় অটোমোবাইল স্কিলস ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’ স্থাপনের প্রস্তাব করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সুদক্ষ নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পন্নোত দেশ হতে উন্নত দেশে পরিণত হবে। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার এবং আশা প্রকাশ করেন সামনের দিনগুলোতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে দেশের মানুষের মাঝে নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি আধুনিক সুবিধাসম্বলিত যানবাহন ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে, যেটি অটোমোবাইল খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এখাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য একটি সহায়ক নীতিমালার খসড়া প্রস্তুতের কাজ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়, যেটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে। পাশাপাশি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে এখাতের যন্ত্রাংশ উৎপাদনে শিল্প-কারখানা স্থাপনে এগিয়ে আসার জন্য দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানাই। এ লক্ষ্যে শিল্প ও শিক্ষা খাতের সমন্বয় খুবই জরুরি।’

সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নায়কি বলেন, ‘অনেক দেশের শিল্পায়নে অটোমোবাইল খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে জাপানে এখাত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অটোমোবাইল শিল্প উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে এবং বাংলাদেশের সেই উদাহরণ অনুসরণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ লক্ষ্যে একটি সমন্বিত নীতিমালা অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন এবং সেই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের অটোমোবাইল খাতের বিকাশকে ত্বরান্তিত করতে হালকা প্রকৌশল শিল্পকে এগিয়ে আসতে হবে। জাপানের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিতসুবিশি বাংলাদেশে ‘সিকেডি প্ল্যান্ট’ স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছে এবং এ বিষয়ক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলমান আছে। অটোমোবাইল খাতের উন্নয়নে স্থানীয় হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশ একান্ত অপরিহার্য।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইফাদ গ্রুপ অব বাংলাদেশ-এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন আহমেদ। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করছে এবং বিশেষ করে পদ্মা সেতু পুরোদমে চালু হলে স্থানীয় পর্যায়ে বাণিজ্যিক যানবাহনের চাহিদা বৃদ্ধির ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। ‘বিবিআইএন মোটর ভিহাইক্যাল এগ্রিমেন্ট’-এর কারণে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিক যানবাহনের চাহিদাও বাড়বে। এখাতে মোট বিনিয়োগ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, জিডিপিতে যার অবদান দশমিক ৫ শতাংশ। আমাদের ব্যবহৃত গাড়ির মধ্যে ৫০ শতাংশ গাড়িই রিকন্ডিশন এবং নতুন গাড়ি সংখ্যা হলো ৫ শতাংশ। খসড়া আটোমোবাইল নীতিমালায় সরকার ব্যবহৃত গাড়ি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা নিয়েছে, যা আমাদের স্থানীয় অটোমোবাইল খাতের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের দেশে বাণিজ্যিক গাড়ির বাজার প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সামনের দিনগুলোতে এ বাজারের বৃদ্ধির আরও সম্ভাবনা রয়েছে। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে অটোপার্টস-এর বাজার প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা এবং বার্ষিক এ খাতের প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১২ শতাংশ।’

ওয়েবিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশস্থ মার্কিন দূতাবাসের ইকোনোমিক অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স ইউনিট-এর প্রধান জন ডি ডানহাম, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদুজ্জামান, উত্তরা গ্রুপ অব কোম্পানিজ-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমান এবং বারভিডা’র সভাপতি আবদুল হক প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।

মতিউর রহমান বলেন, ‘দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে অটোমোবাইল খাতের উন্নয়নের প্রচুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে পর্যালোচনার মাধ্যমে খসড়া অটোমোবাইল নীতিমালা বাস্তাবয়নের আহ্বান জানান। এছাড়াও অটোমোবাইল খাতের শিল্পায়নকে আরও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’

মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘সিবিও ভিহাইক্যালের মাধ্যমে আমাদের দেশের যানবাহনের চাহিদা মেটানো হয়। তবে আমাদের লক্ষ্য হলো নিজস্ব গাড়ির ব্রান্ড তৈরি করা। আমরা বর্তমানের অ্যাসেম্বেলিং হতে প্রগ্রোসিভ ম্যানুফেকচার্স হিসেবে রপান্তরিত হতে যাচ্ছি। এজন্য খুচড়া যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’

বারভিডা’র সভাপতি আবদুল হক বলেন, ‘অটোমোবাইল খাতের বিকাশে আমাদের নিজস্ব বাজার তৈরিই বড় চ্যালেঞ্জ এবং নিজস্ব বাজার সম্প্রসারণে সরকারকে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি শিল্পমন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এখাতে বিদেশি বিনিয়োগকে আমরা স্বাগত জানাই। গাড়ি আমদানিতে আমাদের ১২০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়, যার জন্য আমদানিকৃত গাড়ির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায়, স্থানীয় বাজারে চাহিদা আশানুরূাপভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এখাতের বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা প্রদান একান্ত অপরিহার্য।’

সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘গাড়িতের ব্যবহৃত ‘ইলেকট্রেনিক কন্ট্রোল ইউনিট (ইসিইউ)’ উৎপাদনে ও এটি ব্যবহারের সফটওয়্যার তৈরিতে দক্ষ মানব সম্পদের জন্য বাংলাদেশকে এগিয়ে আসতে হবে।’

জাইকা প্রতিনিধি হায়াকাহ ইউকো বলেন, ‘এখাতের মাধ্যমে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, যা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে একটি যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন, বিনিয়োগ প্রণোদান ও ট্যাক্স সহায়তা প্রদান, স্থানীয় উৎপাদানকারীর সক্ষমতা বাড়ানো এবং স্থানীয় চাহিদা বাড়ানোর করতে হবে।’

জন ডি ডানহাম বলেন, ‘এখাতের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাসমূহকে সহায়তা প্রদান করতে হবে। দেশের অর্থনীতির গতিধারা বজায় রাখতে হবে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের কোন বিকল্প নেই এবং এক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তি ও অটোমোবাইল খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।’

ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এন কে এ মবিন ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেনসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা ওয়েবিনারে যোগদান করেন।