স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রুপান্তর হয়নি।
হবিগঞ্জ থেকে মাসুদ লস্কর: আজ ৪এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে বসেই তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ভারতীয় প্রতিনিধিদের এক বৈঠকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত রুপরেখা প্রনয়নসহ সারা দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধের শুভসূচনা করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর নির্বিচারে বর্বরোচিত গণহত্যা চালায় তখন বিক্ষিপ্তভাবে বাঙালীরা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। একপর্যায়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বড় বাংলোতে ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা, স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও ভারতীয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গঠন করা হয়েছিল জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে একটি সুশৃঙ্খল মুক্তিবাহিনী। সারা দেশকে প্রথমে বিভক্ত করা হয় ৫ টি সেক্টরে। পরবর্তীতে ১০ এপ্রিল একই স্থানে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বৈঠকে সেক্টরের সংখ্যা বাড়িয়ে ছয়টিসহ পুরোদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব সিদ্ধান্ত এসেছিল তেলিয়াপাড়ায় চা বাগানের এই ম্যানেজার বাংলো থেকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ গ্রহন ও সম্মুখ সমরের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করা সহ মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত এখান থেকেই এসেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে চাইলেই তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোটির কথা চলে আসে সর্বাগ্রে। হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের চারপাশে ছায়া ঘেরা সবুজ বেষ্টনী আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি নির্জন এই স্থানকেই নিরাপদ মনে করেছিলেন স্বাধীনতাকামী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের দেশপ্রেমিক উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা।
৪ এপ্রিলের ঐতিহাসিক সেই বৈঠকের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর কর্নেল পরবর্তীতে জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন তৎকালীণ কর্নেল এম এ রব, মেজর সি আর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নাসিম, লে. সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রমুখ।
রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে মস্তোফা আলী, সাবেক এমপিএ মৌলানা আসাদ আলী, এনামুল হক মস্তোফা সহিদ, হুমায়ুন আলী চৌধুরী (দুলাল) মিয়া, ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে অংশ নেন ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল। বৈঠক শেষে এমএজি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি আকাশের দিকে ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ওসমানী ও এম এ রবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ করানো হয়। শপথবাক্য পাঠ করান এমএজি ওসমানী। সেই সময় তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজার বাংলোটিই মুলত ৩ নম্বর সেক্টরের সদরদপ্তর ছিল। এখানেই অস্থায়ী মুজিব নগর সরকারও গঠনে কথা ছিল।
কিন্তু ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে তখনই ভৌগোলিক অবস্থান ও নিরাপত্তা জনিত কারনে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান থেকে ওই কার্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয়। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও স্মৃতির রাজস্বাক্ষী হয়ে মিশে আছে তেলিয়াপাড়া চা- বাগানের ম্যানেজার বাংলোটি। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধেরও স্মৃতিও এই বাংলোটি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজানপুর ইউনিয়নের ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোটিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর করার স্বপ্ন আজও বাস্তবে রুপ নেয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজও তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের বাংলো হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অবশ্য ২,৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বাংলোর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নির্মিত হয়েছে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। বাংলোর দক্ষিণ দিকে লাগানো ফলকটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত। সেখানে স্মৃতিফলকে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনা, সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা।
চা-বাগানের সবুজের বেষ্টনীতে স্মৃতিসৌধ ছাড়াও আছে দৃষ্টি নন্দন ও নয়নাভিরাম একটি প্রাকৃতিক মিঠাপানির হৃদ। লাল–শাপলা ফোটা এই হৃদটি বর্ষাকালে অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। স্মৃতিসৌধ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই ঐতিহাসিক বাংলোটি। স্থানীয় জনগন বহুকাল ধরেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাৎপর্যময় বাংলোটিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার দাবী করে আসছে। প্রবীণ রাজনিতিবিদ,বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ মোঃমু সলিম বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিরা এখানে এসে বার বার যাদুঘর হবে বলে আশ্বাস দিয়ে যায় কিন্তু এর বাস্তবতা দেখছিনা। স্মৃতিসৌধ এলাকায় অরক্ষিত থাকায় বহিরাগত লোকজন এসে এখানে মাদক সেবন করে, যা খুবই দুঃখজনক। জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী এই ম্যানেজার বাংলোটিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রুপান্তর করে মুক্তিযুদ্ধের এখানকার স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা হোক।