আমদানি কমে যাওয়ার বিপরীতে বিদেশি ঋণ ও প্রবাসী আয় বাড়ায় দেশে মার্কিন ডলারের চাহিদা কিছুটা কমেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ডলারের জোগান কমিয়ে দিয়েছে। তারপরও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত রয়েছে। গতকাল স্থানীয় মুদ্রায় ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সায়। চলতি বছরের ৩ অক্টোবরের তুলনায় ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার আরও বেশি অবমূল্যায়নের চাপ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে গড়ে প্রতি মাসে ১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার জোগান দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকার মান ধরে রাখতে গত অর্থবছরে মোট ২৩৪ কোটি ডলার জোগান দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে টাকার মান ধরে রাখতে ডলারের সরবরাহ কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের বছরের তুলনায় চলতি বছর ডলারের চাহিদাও কিছুটা কমে। এ কারণে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত মাত্র ২৯ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত রপ্তানি খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পকে বৈশি^ক প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে ডলারের বিপরীতে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন হতে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন বিনিময় মূল্য ধরে রাখার পর গত অক্টোবর থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে ডলারের চাহিদা কমলেও টাকার অবমূল্যায়নের এ উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
টাকার অবমূল্যায়নে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ থেকে অনেক দিন ধরেই দাবি জানানো হচ্ছিল। বিশ^ অর্থনীতির ধীরগতি ও চীন–মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবের কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের রপ্তানি খাত হোঁচট খায়। রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার ধারাবাহিকতা অক্টোবরেও দেখা গেছে। চলতি ২০১৯–২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই–অক্টোবর) ১ হাজার ২৭২ কোটি ১২ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। মূলত তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের চার মাসে ১ হাজার ৫৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম। একই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের টাকার অবমূল্যায়ন তুলনামূলক কম হওয়ায় তৈরি পোশাক চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত মাত্র ২৯ কোটি ডলার খাত রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে বলে দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ। এমন পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন না হলে তাদের জন্য আলাদা বিনিময় হারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও অবমূল্যায়নের দাবি জানিয়ে আসছিল। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে রপ্তানি আয় কমলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসীরা প্রায় ৫১০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ে চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। এছাড়া ২০১৮–১৯ অর্থবছরে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ প্রায় বেড়েছে। এ সময় প্রকল্প সহায়তা ৩ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন থেকে ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এসব কারণে ডলারের চাহিদা আগের তুলনায় অনেকটা কমে গেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমদানি কমে যাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। তবে প্রবাসীদের পাঠানো আয়ে ২ শতাংশ নগদ সহায়তা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি রেমিট্যান্স আসছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে কিছুটা চাপের মধ্যে রেখেছি। গ্রাহকদের রপ্তানি আয় বাড়াতে সেবা দিতে বলেছি। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর বিদেশি মুদ্রার আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বলেছি। এসব কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে, চাহিদা কমেছে।
চলতি বছরের অক্টোবরে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৮৪ টাকা ৭৫ পয়সায় সীমাবদ্ধ ছিল। আর ২০ নভেম্বরে এই হার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়ায়, যা গতকাল ৮৪ টাকা ৯০ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। যদিও কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার ৮৭ টাকা ৪০ পয়সা ছাড়িয়ে গেছে।
গত ৩ মে থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায় আটকে ছিল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা। ওই সময় থেকে গতকাল পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে টাকা। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা। তবে বাংলাদেশে টাকার অবমূল্যায়ন প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ যে হারে তাদের স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে, তার তুলনায় টাকার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন কোনো প্রভাবই ফেলবে না। পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। টাকার অবমূল্যায়ন হলে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।