শরীফ আস্-সাবের
১.
আমার স্বল্প সময়ের সাংবাদিকতা জীবনের শুরুটা আকস্মিক হলেও সাংবাদিক হওয়ার গল্পটা বেশ সোজাসাপ্টা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র। থাকি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে। আমার বেশীর ভাগ সময় কাটতো টুকটাক ছড়া কবিতা লেখা, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ধুন্ধুমার আড্ডাবাজি আর টো টো করে উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানোতে। পড়াশোনা বরাবরের মতই আমার কাছে ছিল একটা একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর বিষয়। তাই ততটুকুই পড়তাম যতটুকু না করলেই নয়। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলাম না আমি। হঠাৎ মনে হলো, সাংবাদিকতা করলে কেমন হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পরিচিত মহলে বেশ কয়েকজন এই পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সানাউল হক, শওকত মাহমুদ, আফম সিরাজউদ্দৌলা, মীর্জা তারেকুল কাদের, খায়রুল আনোয়ার মুকুল প্রমূখ উল্লেখযোগ্য।
খুঁজে দেখলাম, ভালো পত্রিকাগুলোর মধ্যে একমাত্র দৈনিক সংবাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারের পদটি খালি আছে। যদিও ‘খেলাঘরে’ লেখালেখি এবং এর কার্যক্রমের সঙ্গে খানিকটা জড়িত থাকার সুবাদে বযলুর রহমান ভাইয়া এবং আমার হোমটাউন নরসিংদীর যোগসূত্রে কার্তিক চ্যাটার্জিদাসহ সংবাদের আরো দু’চারজনকে আমি চিনতাম, আমি উনাদের কারো কাছে না গিয়ে সরাসরি পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই।
দিনটি ছিলো রবিবার, ২৪শে মে, ১৯৮১। সাপ্তাহিক সরকারী ছুটির দিন। শেষ বিকেলের মিহি রোদে হেঁটেই রওয়ানা হলাম। পুরনো ঢাকা তেমন ভালো না চিনলেও এক সময় শহিদুল্লাহ হলে থাকার সুবাদে এ অঞ্চলটি সম্পর্কে ধারণা একেবারে মন্দ ছিল না। পলাশী, চানখাঁর পুল, সিদ্দিক বাজার পার হয়ে নবাবপুর রোডে পড়লাম। তারপর, বংশালের রাস্তায় ঢুকে নিশাত সিনেমা হল বায়ে রেখে ডান দিকে ২৬৩ বংশাল রোডের দৈনিক সংবাদ অফিসে পৌঁছাতে সময় লাগলো প্রায় তিরিশ মিনিট। তারপর, প্রধান গেইটে বসে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করে হাজির হয়ে গেলাম বার্তা সম্পাদক জনাব আব্দুল আওয়াল খানের টেবিলে। তাঁর সামনে সালাম দিয়ে দাঁড়াতেই তিনি কাগজের স্তুপ থেকে মুখ তুলে দু আঙ্গুলে চশমাটি ঠিক করে অপরিচিত আমাকে দেখে ভাবগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘কি চাই?’ প্রত্যুত্তরে আমি দ্রুততার সঙ্গে আমার ইচ্ছার কথাটা তাঁকে বলে ফেললাম। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘আগামীকাল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকদের একটি ধর্মঘটের কর্মসূচি আছে। কর্মসূচিটি কাভার করে কাল বিকেলে একটি রিপোর্ট লিখে নিয়ে আসবেন’। তারপর, আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি আবার তাঁর কাজে মনোনিবেশ করলেন।
একরাশ উটকো চিন্তা মাথায় করে ফিরে এলাম হলে। বার্তা সম্পাদকের চাছাছোলা কথার পর কেন জানি প্রিয় কবি মধুসূদন দত্তের কবিতার একটি লাইন বার বার মনে পড়তে লাগলো, ‘বৃথা এ সাধনা, ধীমান’…! তা সত্ত্বেও পরদিন লেগে গেলাম খবর সংগ্রহে। শুরুতেই জানলাম ধর্মঘটের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে। তারপর, শিক্ষকদের মিছিল ও সভা অনুসরণ করা শেষে দেখা করলাম শিক্ষক সমিতির ঐ সময়কার সভাপতি অধ্যাপক সাদউদ্দিনের সঙ্গে এবং তাঁর কাছ থেকে ধর্মঘটের হেতু ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে আরো কিছু জানার চেষ্টা করলাম।
দিনশেষে, যথা আজ্ঞা, শিক্ষকদের ধর্মঘট নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখে তা বার্তা সম্পাদকের কাছে পৌঁছে দিতে আবার হাজির হলাম তাঁর টেবিলে। তিনি ভাবলেশহীন একই কায়দায় মাথা তুলে একবার আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, ‘রিপোর্ট এনেছেন তাহলে! আচ্ছা, রেখে যান’।
হলে ফিরে এলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা শেষে রাত কাটলো প্রায় নির্ঘুম। পরদিন সকালে হল গেইটে পত্রিকাওয়ালা আসার সঙ্গে সঙ্গেই কিনলাম দৈনিক সংবাদের এক কপি আর পত্রিকার প্রথম পাতায় আবিস্কার করলাম আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম লেখা। পড়ে দেখলাম, বার্তা সম্পাদক মহোদয় কোন রকম পরিবর্তন বা পরিমার্জন ছাড়াই আমার লেখাটি ছাপার অনুমোদন দিয়েছেন। প্রথম পাতায় প্রথম লেখা, তাও আবার কোনরকম কাটাছেঁড়া ছাড়া! পুলকিত হলাম আর সেই সাথে শুরু হলো ‘বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার’ হিসেবে আমার খন্ডকালীন সাংবাদিক জীবন।
২.
সেইদিন বিকেলে আবার গেলাম ২৬৩ বংশাল রোডে। এই দফায় আমায় দেখে বার্তা সম্পাদক মহোদয় উঠে দাঁডিয়ে হাত বাড়ালেন, আমি তাঁর হাতে হাত মিলিয়ে যেন এক আন্তরিকতার উষ্ণ পরশ পেলাম। তিনি মৃদু হেসে আমাকে বসতে বললেন। আমি চা খাবো কিনা, জিজ্ঞেস না করেই পিয়নকে ডেকে দু’কাপ চা আনতে বললেন। তারপর সংক্ষেপে কুশলাদি বিনিময় করে আমার রিপোর্টটির প্রশংসা করলেন। সেইসাথে কিভাবে আরো ভালো রিপোর্টিং করা যায় এ নিয়ে দু’চার কথা বললেন। এই আলাপচারিতার মধ্যেও তিনি ফাইল পত্র দেখছিলেন, কলমও চালাচ্ছিলেন। সেই সুবাদে আমি তার মধ্যে যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম এক সব্যসাচী মানুষকে। ইতোমধ্যে চা এর সঙ্গে দুটি সিঙ্গারাও এলো। চা পর্ব শেষে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে বার্তা বিভাগে উপস্থিত সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন সংবাদের নতুন বিশ্বিবিদ্যালয় রিপোর্টার হিসাবে। তারপর একজন এসে উনার কাছে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেলেন যা তিনি একটু চোখ বুলিয়ে আমার হাতে দিলেন যা ছিল সংবাদের প্রধান নির্বাহী স্বাক্ষরিত আমার জীবনের প্রথম নিয়োগপত্র – পদবী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার। মাসিক বেতন সাকুল্যে ২০০ টাকা।
এরপর প্রতিদিন সংবাদে হাজিরা দেওয়া আমার কাছে ছিল নেশার মত। স্বল্পভাষী আওয়াল ভাই সেই সুবাদে হয়ে গেলেন একজন কাছের মানুষ। একজন মেধাবী, বিচক্ষন, নীতিবান এবং কাজপাগল সাংবাদিক ছিলেন আউয়াল ভাই। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রথম সভাপতি, নিরহংকার, সাদা মনের মানুষ আব্দুল আওয়াল খান কোন ধরণের আত্মপ্রচার বা বাগাড়ম্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। সংবাদে আমার স্বল্প সময়ের চাকুরীকালীন তাঁর কাছে সাংবাদিকতার পাঠ ছাড়াও পেয়েছি অঢেল স্নেহ ও মমতা। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই নিবিড় শ্রদ্ধা।
ড. শরীফ আস্-সাবের: কবি, লেখক ও সুশাসন বিশেষজ্ঞ। সাবেক আমলা ও সাংবাদিক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া স্টেটের আন্তঃসংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীর দক্ষিন এশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি মেলবোর্ন ভিত্তিক উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, Governance and Administration Innovation Network (GAIN Internatioal) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
সংযুক্তি:
দৈনিক সংবাদ
প্রথম পাতা
২৬ মে, ১৯৮১