শুভ্র মুখোপাধ্যায়
মহাতারকারা অতীত ভোলেন না। অতীত তাঁদেরকেও প্রেরণা দেয়। স্পেনের বিরুদ্ধে মরক্কো যখন টাইব্রেকারে জিতে শেষ আটে গেল, সেইসময় সাইদা মু কোথায় ছিলেন, বলতে পারেন? নিশ্চয়ই মাঠের একটি কোনায় বসে কাঁদছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন, কত কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছেন, সেই ছেলেকে আজ সারা বিশ্ব চিনছে।
আশরাফ হাকিমি । মরক্কোর তুখোড় রাইটব্যাক। এই ফুটবলারের জীবন সংগ্রাম নিয়ে আস্ত একটা বই লেখা হয়ে যাবে। মরক্কোর ফুটবলার হলে স্পেনে জন্মেছেন। ছোট বেলা থেকে দারিদ্রকে সামনে থেকে দেখেছেন। মা সায়দা মু বাড়ি বাড়ি সাফাইয়ের কাজ করতেন। বাবা হাসাম হাকিমি রাস্তায় রাস্তায় খেলনা বিক্রি করে বেড়াতেন।
আশরাফকে বড় ফুটবলার করার পিছনে মায়ের অবদান অনেকখানি। ছেলে প্র্যাকটিস করতে যেতেন, মা টিফিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। এমনও অনেকদিন হয়েছে, টিফিন কেনার পয়সা নেই, মা তাও দাঁড়িয়ে রয়েছেন ছেলের ঘাম মুছিয়ে দেবেন বলে!
ভালবাসায় সব হয়, ভালবাসায় পৃথিবী হাতের মুঠোয় আনা যায়। তাই এনেছেন আশরাফ। বুধবার সকালে মেট্রো করে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম কয়েকজন যুবক-যুবতীকে। এক যুবতীর জার্সিতে হাকিমি লেখা। তার মানে তিনি মরক্কোর জনতার হৃদয়েও স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর চোয়াল চাপা লড়াইয়ের স্বীকৃতি দিচ্ছেন দেশের মানুষ। আজীবন স্পেনে বেড়ে উঠলেও দেশের প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা। সেটি মা-ই শিখিয়েছেন আশরাফকে।
তাই গত বেলজিয়াম ম্যাচ শেষে গ্যালারির সামনে এসে মা সায়দাকে খুঁজছিলেন হাকিমি। যখন দেখতে পেলেন, দু’জনেই অঝোরধারায় কাঁদছেন। মা আবার ছেলের কপালে চুমু খেলেন। আশরাফের স্ত্রী আবার আধুনিকা ও স্প্যানিশ মডেল, একাধারে নামী অভিনেত্রী হিবা আবৌক, তিনিও মা-ছেলের এই আবেগকে সম্মান করেন।
পরদিনই হাকিমি নিজের টুইট থেকে আরবি ভাষায় একটি বার্তা লিখলেন, উহিব্বুকে উম্মি। ‘‘আমি আমার মা-কে খুব ভালবাসি।’’ ভালবাসার একটি লাল সাংকেতিক চিহ্ন। নিচে সেই আবেগঘন ছবি।
পিএসজি-র রাইটব্যাক আশরাফের জীবন খোলা পাতার মতোই। সেদিনও নিজের দেশের সংবাদমাধ্যমকে আশরাফ বলেছেন, ‘‘আমার মা ঘর পরিষ্কার করতেন। বাবা ছিলেন রাস্তার বিক্রেতা। আমরা একটি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছি। আমার মা-বাবা আমাদের জন্য যা কষ্ট করেছেন, তাঁদের কথা ভেবেই রোজ লড়াই করি। যাবতীয় সাফল্য তাঁদের উৎসর্গ করতে পারলেই খুশি হব।’’
শিকড়ের প্রতি অসম্ভব টান হাকিমির। ইচ্ছে করলেই খেলতে পারতেন স্পেনে। কিন্তু মরক্কোকেই নিজের দেশ ভাবেন। তাই পর্তুগালের বিপক্ষে খেলতে নামার আগে হাকিমি নিয়ে মরক্কোনদের আবেগ রয়েছে বিস্তর। ২৪ বছরেই তিনি তারকার তারকা।
পর্তুগাল ম্যাচের সময় আশরাফের পুরো পরিবার মাঠে থাকবে। মা সায়দা, বাবা হাসাম, স্ত্রী হিবা ও দুই সন্তানও। সেদিন পর্তুগিজদের হারালে আশরাফ আরও একবার চোখের জল ফেলবেন, সেটি তো আনন্দাশ্রু। হারলেও সবাই সেদিন কাঁদবেন, ব্যর্থতার জন্য নয়, নিজেদের জীবন সংগ্রামে ‘জয়ী’ হওয়ার জন্য।