দরদর করে ঘাম হচ্ছে। কপাল-গলা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্বেদবিন্দু। ঘামতে ঘামতেই ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল লোকটা। অসাড় হতে থাকল হাত-পা। শিরদাঁড়া বেয়ে যেন হিমস্রোত নেমে গেল। শক্ত হয়ে গেল পেশি। এরপর বড় জোড় আধ ঘণ্টা। তারপরেই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। সেই ঘাম গড়িয়ে লাগল যার গায়ে, নিশ্চিত মৃত্যু হল তারও। কোনও সায়েন্স ফিকশনের গল্প বলছি না। এমন ঘাম-রোগ দেখা দিয়েছিল এই পৃথিবীতেই। এখন যেমন ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্ববাসী তটস্থ। সর্দি-কাশি, থুতু-লালা থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে অতিমহামারী হয়ে উঠেছে। তেমনি ঘাম থেকেও ছড়িয়েছিল এক মারণ রোগ। সেই রোগও মহামারী হয়ে মৃত্যুর পর মৃত্যু ঘটিয়ে চলেছিল। শ্মশান হয়ে গিয়েছিল কত শহর, গ্রাম।
অসুখ জানান দিয়ে আসত না। আচমকাই শরীরে শিহরণ, গলগল করে বেরিয়ে আসা ঘাম, দুর্গন্ধ, অন্তিম পরিণতি মৃত্যু। ভাবতেও অবাক লাগে আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে এমন ঘাম-রোগের শিকার হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। ইউরোপই ছিল এই ছোঁয়াচে বিদঘুটে অসুখের ভরকেন্দ্র। সূচনাটা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। তারপর উল্কাগতিতে অসুখ ছড়িয়েছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশে। কী থেকে রোগ ছড়াচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই শ্মশানের স্তব্ধতা নেমে এসেছিল শহরের অলিতে গলিতে। রাজপরিবারের অন্দরমহলে। সে এক দুঃস্বপ্নের সময়। স্প্যানিশ ফ্লু, ব্ল্যাক ডেথ, কালাজ্বর, পীত জ্বর এবং হালে ইবোলা, সার্স, মার্স, করোনাভাইরাসের থেকেও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল সে মহামারী। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ৫০০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এই রোগের কারণ খোঁজা হয়নি সেভাবে, কালের গতিতে ইতিহাসের হলুদ পাতায় চির সমাধি হয়েছে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মসনদে তখন সপ্তম হেনরি, যুদ্ধশেষে ধূমকেতুর মতো আছড়ে পড়ল মহামারী
পৃথিবীতে যত মহামারী হানা দিয়েছে তার বেশিরভাগটাই কোনও না কোনও যুদ্ধ চলাকালীন বা যুদ্ধ পরবর্তী সময়েই হানা দিয়েছে। এই ঘাম-রোগ যখন ছড়িয়েছিল তখন পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক। ১৪৮৫ সাল। বসওয়র্থ ফিল্ডের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ১৪৫৫ সালে শুরু হওয়া ‘ওয়ার অব রোজেস’-এর শেষ পর্যায় বসওয়র্থ ফিল্ড ওয়ার। প্রায় ৩২ বছর ধরে ল্যাঙ্কাস্টার ও ইয়র্কের মধ্য রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পরে ইংল্যান্ড প্রায় বিচ্ছিন্ন, তছনছ হয়ে পড়েছে। একদিকে রাজা তৃতীয় রিচার্ড অন্যদিকে হেনরি টিউদারের সমর্থকদের মধ্যে এক সাঙ্ঘাতিক লড়াই। যাই হোক, এই লড়াইয়ের ইতিহাস আজকের বিষয় নয়। রোগ যখন ছড়ায় তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মসনদে রাজা সপ্তম হেনরি রাজ করছেন। ১৪৮৫ সালের অগস্ট মাস। এক অজানা অসুখ ছড়াতে শুরু করল ব্রিটেনে।
ঘাম হয় আর তারপরেই মৃত্যু। প্রথমে বোঝা যায়নি। ডাক্তার-বদ্যিরা ভেবেছিলেন আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। কিন্তু গণ্ডগোলটা বোঝা গেল কিছুদিন পর থেকে। ১৯ সেপ্টেম্বর। সুপার সাইক্লোনের মতো লন্ডনে আছড়ে পড়ল সেই অজানা রোগ। ঝড়ের ঝাপটায় কেঁপে গেল রাজপরিবারের অন্দরমহলও। ছোঁয়াচে ঘাম সংক্রামক মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ল শহরে শহরে। কয়েকদিনে মৃত্যু হল কয়েক হাজার মানুষের। অক্টোবরে গিয়ে দেখা গেল মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। রাজার সভাসদ-পারিষদরাও রয়েছেন তালিকায়, রাজপরিবারের দাসদাসী, কর্মচারীরাও আক্রান্ত। একদিকে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ক্ষয়ক্ষতি, অন্যদিকে এক অজানা রোগ, মহা বিপদে পড়লেন রাজা সপ্তম হেনরি।
ইতিহাসের পাতায় রহস্যময় ঘাম-রোগ নিয়ে এইসব ছবিই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
ঘাম হয়, শরীর ঠান্ডা হয়, তারপরেই জ্বালাপোড়া গরম—এ রোগ না অভিশাপ
১৫৫১ সালে শ্রিউসবারির চিকিৎসক জন কেইয়াস এই রোগকে প্রথম শণাক্ত করলেন। তিনি বললেন সোয়েটিং সিকনেস (Sweating Sickness) । ইংরাজিতে সোয়েট মানে ঘাম। এই ঘাম থেকেই ছড়াচ্ছে রোগ। এই সোয়েটিং সিকনেসকে পরে অবশ্য ইতিহাসবিদরা নানা নামে ডেকেছিলেন, বাংলায় বলা হয়েছিল স্বেদন রোগ বা স্বেদন বালাই। সে যাই হোক, রোগ তো ছড়াল, কিন্তু এ রোগ যে জানান দিয়ে আসে না। কোনও উপসর্গ নেই, আচমকাই দরদর করে ঘাম হচ্ছে আর তারপরেই সব শেষ। জন বললেন, রোগের দুটি পর্যায় আছে। প্রথমটা ‘কোল্ড স্টেজ’—এই পর্বে রোগীর সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসবে। কাঁপুনি দেবে। পেশিতে খিঁচুনি দেখা দেবে। গলা, কাঁধ, হাত-পায়ের পেশিতে অসহ্য যন্ত্রণা হবে, সেই সঙ্গে বুকে ভীষণ চাপ। কোল্ড স্টেজ থাকবে আধ ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টার মতো। যার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি, তার টিকে থাকার সময়ও বেশি। এই কোল্ড স্টেজের পরে আসবে ‘সোয়েটিং স্টেজ’। এই পর্বে হঠাৎ করেই শরীর গরম হতে থাকবে। প্রচণ্ড ঘাম হবে, সঙ্গে মাথাযন্ত্রণা। নাড়ির গতি বাড়বে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। রোগী যখন হাঁসফাঁস করতে শুরু করবে তখনই মোক্ষম ঝাপটা আসবে। আচমকা অসাড় হয়ে যাবে হাত-পা, বন্ধ হবে হৃদগতি। তারপরেই মৃত্যু।
রাজা সপ্তম হেনরিকে এই রোগের বিশদ বিবরণ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ডাক্তার থমাস ফ্রস্টিয়ার। তিনিও তখন সোয়েটিং ডিজিজ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। রোগীদের পরীক্ষা করছেন। থমাস বললেন, বসন্তকাল আর গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণেই ছড়াচ্ছে এই রোগ। কী কারণে ঘাম হচ্ছে তা অবশ্য তিনি ধরতে পারেননি। তবে রোগের কিছু লক্ষণ বলেছিলেন। চিঠিতে থমাস লিখেছিলেন, ঘাম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেছে রোগীর হার্ট ও ফুসফুসের চারপাশে বাষ্প জমছে। স্বাসকষ্ট হচ্ছে রোগীর। তবে ত্বকে কোনও র্যাশ, ফোস্কা বা চুলকানি দেখা যাচ্ছে না কারও। শরীরের ভেতরটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে আর তাতেই দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হচ্ছে রোগীর।
রোগের বিবরণ শুনে হইচই পড়ে যায় ব্রিটেনে। বসওয়ার্থ ফিল্ড যুদ্ধের দোহাই দিয়ে অনেকে বলেন রাজা সপ্তম হেনরিকে জোর করে সিংহাসনে বসানো হয়েছে, আর তাতেই কুপিত হয়েছেন দেবতারা। এ কোনও রোগ নয়, আসলে এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে ইংল্যান্ডবাসীকে।
ষোড়শ শতকে অসুখ মহামারী, রাজপরিবারেও ঘনাল মৃত্যু, চিকিৎসকরা বললেন বাষ্প-রোগ
১৪৮৫ থেকে ১৫৫১ সাল অবধি ইউরোপে তাণ্ডব করেছিল ঘাম-রোগ। একে একে আক্রান্ত হচ্ছিলেন রাজপরিবারের সদস্যরাও। সপ্তম হেনরির দাদা ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ আর্থার পড়লেন ঘাম-রোগের কবলে। সংক্রমণ ছড়াল তার স্ত্রী ক্যাথরিন অব অ্যারাগনের শরীরেও। সেটা ১৫০২ সাল। রাজপরিবারের বদ্যিরা বললেন ‘বাষ্প-রোগ’। ব্ল্যাক ডেথ, টিউবারকিউলোসিস, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই ছোঁয়াচে হয়ে উঠেছে এই অসুখ। ডাক্তাররা সেই সময় ভেবেছিলেন বাতাস থেকে ছড়াচ্ছে রোগ। অথবা নিকাশী নালা, মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি রোগের কারণ। আর্থারকে বাঁচানো যায়নি। ঘাম-রোগের কারণ খুঁজতে ২০০২ সালে ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিকরা আর্থারের কবর খুঁড়ে বের করেছিলেন। কিন্তু কী থেকে সেই রোগ ছড়িয়েছিল তা বোঝা যায়নি।
১৫০৭,১৫১৭ সালে ফের মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছিল এই অসুখ। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। চতুর্থ মহামারী দেখা দিয়েছিল ১৫২৮ সালে। সেবার ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল অসুখ। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলসে সংক্রমিত হতে শুরু করেছিলেন মানুষজন। আর এদিকে নিজের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতেন রাজা সপ্তম হেনরি। ইংল্যান্ডের সবকটি প্রাসাদে তখন হানা দিয়েছিল এই মারণ রোগ। রাজার মন্ত্রী থমাস ক্রমওয়েল তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে হারিয়েছিলেন।
ভাইরাস ঘটিত রোগ না মারণাস্ত্র—কারণ অজানা
ঘাম-রোগের আসল কারণ এখনও জানা সম্ভব হয়নি। প্রায় ৫৩৬ বছর আগে যে রোগ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে তার কারণ হিসেবে অনেকরমক তথ্য উঠে এসেছিল। গবেষকরা বলেছিলেন, হান্টা ভাইরাস রোগের কারণ হতে পারে। ইঁদুর, বাদুড় জাতীয় প্রাণীর থেকে ছড়িয়েছিল অসুখ। যেসব উপসর্গ দেখা দিয়েছিল সেগুলোর সঙ্গে হান্টাভাইরাস পালমোনারি সিন্ড্রোমের বিস্তর মিল ছিল। তবে হান্টাভাইরাসই রোগের কারণ কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
অন্য তথ্য হিসেবে ধরা হয়েছিল অ্যানথ্রাক্স রোগকে। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামে ব্যাকটেরিয়া নিঃশ্বাস, ত্বকের ক্ষত দিয়ে বা খাবারের মাধ্যমে বাহিত হয়ে সংক্রমণ চড়াতে পারে। গবাদি পশুর থেকে এই রোগ ছড়ায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে সেই ব্যাকটেরিয়া।
ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি মারণাস্ত্রের প্রসঙ্গও তুলেছিলেন কযেকজন গবেষক, ইতিহাসবিদ। দায়ী করা হয়েছিল ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধকে। জৈবিক মারণাস্ত্র ছড়িয়ে দিয়ে মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। যদিও এই তথ্যেরও প্রমাণ মেলেনি। ঘাম-রোগের প্রায় দুশো বছর পরে ১৭১৮-১৯১৮ সালের মধ্যে ফ্রান্সে ‘পিকার্ডি সোয়েট’ নামে প্রায় একই রকম রোগ ছড়িয়েছিল। কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সে রোগের কারণও ছিল অজানা। ব্রিটেনের সোয়েট ডিজিজ আর ফ্রান্সের পিকার্ডি সোয়েটের মধ্যে যোগসূত্র ছিল কিনা তাও ধরতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। ঘাম-রোগ এখনও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।