বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
ঢাকা: প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। নির্বাচন সংক্রান্ত গুরুতর অসদচারণ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে এই দাবি জানানো হয়।
১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ তুলে ধরেছেন। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন তারা। এ বিষয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলার জন্য সময় চেয়ে অনুরোধ করেছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।
একই ধরনের চিঠি তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দেবেন বলে জানিয়েছেন।
শনিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দিলীপ সরকার। এতে নির্বাচন কমিশনের ‘গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক দুর্নীতির’ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরা হয়। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- নির্বাচন কমিশনারদের বিশেষ বক্তা হিসেবে দুই কোটি টাকা গ্রহণ, নিয়োগের নামে চার কোটি আট লাখ টাকার দুর্নীতি, নিয়ম বহির্ভূতভাবে তিনটি করে গাড়ি ব্যবহার এবং ইভিএম কেনায় অনিয়ম। আর অসদাচারণের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ, ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদচারণ।
সংবাদ সম্মেলনে শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমরা সবাই মনে করেছি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নির্বাচন কমিশন যেসব কার্যকলাপ করেছে সেগুলো গুরুতর অসদাচরণ। সাংবিধানিক পদে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের। দুদক বা পুলিশ এটা করতে পারবে না। রাষ্ট্রপতি এ নির্দেশ দিতে পারেন। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতিকে অভিযোগ জানিয়েছি। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা আশা করছি, গুরুতর অসদাচরণের দায়ে তারা দোষী হবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের পদ থেকে অপসারণ করবেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন কোনও নির্বাচন হয় না। নির্বাচন নির্বাচন খেলা হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে আমরা খারাপ নির্বাচন বলি। এখন নির্বাচনগুলো সে রকমই হচ্ছে। নির্বাচন প্রসঙ্গে আমরা গভীর সংকটে আছি। আশা করি মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতির স্বার্থে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে, আগে কখনও দেখা য়ায়নি। তারা আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নির্বাচন কমিশনের নাম অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি। একইসঙ্গে সরকার প্রধানের কাছে যাবো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করবো। যতদিন সিদ্ধান্ত না হয় ততদিন সিইসি ও কমিশনারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারেন, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন আমরা আশা করবো।’
সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডলও একই চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার কথা জানান।
যারা স্বাক্ষর করেছেন-
চিঠিতে সই করেছেন এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অবসরপাপ্ত মহা হিসাব-নিরীক্ষক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড. আই খান পান্না, শাহদীন মালিক, আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সি. আর আবরার, আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এর অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিকাল নিউরোসায়েন্স সেন্টার ও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ-
১. ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে দুই কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম।
২. নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চার কোটি আট লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৩. নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৪. ইভিএম ক্রয় ও ব্যবহারে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৫. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৬. ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৭. খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৮ .গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৯. সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘সংবিধানের ৪৮ (৫) অনুচ্ছেদদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদের আলোচনার জন্য উপস্থাপন করতে পারেন।’
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ করবেন বলে যে আশা প্রকাশ করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতেও কিছু খারাপ নির্বাচন হয়েছে। ‘৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন। এখন যেগুলো হচ্ছে সেগুলোও এরকম। এ ধরনের নির্বাচন কোনও ব্যক্তির কাছে কাম্য নয়। আমরা মনে করি গভীর সংকট রয়েছে। গভীর সংকটে পড়লে জাতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির দিকে তাকায়। তার একটি নৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। আমরা নিঃসন্দেহে আশাবাদী। আমরা আশাবাদী রাষ্ট্রপতি এ অভিযোগের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেবেন।‘
আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তিন বছর পরে কেন এই অভিযোগ- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটেছে। দুই-তিনটা অভিযোগ দিয়ে আমরা এটা করতে চাইনি। অপেক্ষা করেছিলাম, দেখেছি, পর্যবেক্ষণ করেছি। তাদের বিষয়ে অভিযোগ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছি। গুরুতর অসদারচরণ, দুর্নীতি যথেষ্ট হয়েছে। এখানে থাকার নৈতিক অবস্থান আর নেই। অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়েছে।’
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে নির্বাচন কমিশন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাদের এখন সরে দাঁড়ানোই ভালো হবে।’
রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করলেও তা নিয়ে কিছু হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি এটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু পাঠাবেন কিনা সন্দেহ আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলাদা করে পাঠানো যেতে পারে।’