ড: আহমেদ আবদুল্লাহ
বাবরের ঐতিহ্যের এই ধারাবাহিকতা নিয়ে বাবর কন্যা গুলবদন বেগম (১৫২৩-১১০৩ খ্রি.) রচনা করেছেন হুমায়ুননামা।
১৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ফারসি ভাষায় তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থের শিরোনাম হুমায়ুননামা হলেও মূলত এতে বাবর, হুমায়ুন, আকবরের রাজত্বকালের ২২ বছরের প্রধান প্রধান ঘটনাবলির মনােরম ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। শাহজাদা সেলিম তার প্রপিতামহ বাবরের মতাে ইতিহাস বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন।
বাৰৱের পথ ধরে তিনি যে আত্মচরিত রচনা করেন তা তুজুক ই.জাহাঙ্গিরী নামে খ্যাত।
এটি ফার্সি ভাষায় রচিত। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার রাজ দরবারের চাকজমকপূর্ণ বিবরণ ইতিহাস পাঠকদের সামনে খুলেছেন। এই বয়ান মোহামুদ জাহাঙ্গীরের আত্মচরিত তুজুক-ই —হ জাহাঙ্গিরী ভারতীয় উপমহাদেশের মুঘল ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন। মুঘল সম্রাটনের রচিত এসব ইতিহাস গ্রন্থ ছাড়াও মুঘল শাসনামলে আরাে বেশ কিছু ইতিহাসবিদ ছিলেন, যারা বেশকিছু মূল্যবান ইতিহাস গ্রন্থ লুচনা করেছেন।
এ পর্যায়ে ই সম্রাট আকবরের সময়কালে আবুল ফজল আরায়ি, খাজা নিজাম উদ্দিন আহমদ বখশি বা ও আবদুল কাদের কনাউনির কথা উল্লেখ করা যায়। আবুল ফজল আলামি আকবরের দরবারের একজন পরিষদ এবং ঐতিহাসিক ছিলেন। তিনি আকবরনামা’ এবং তার পরিশিষ্ট হিসেবে আইন-ই-আকবনি রচনা করে ঐতিহাসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন আকবরনামার প্রথম দুখণ্ডে তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস থেকে শুরু করে আকবরের রাজত্বকালে ৪৬ বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে।
তৃতীয় খণ্ড আইন-ই-আকবরি- যাতে রাজস্ব, প্রশাসন, ধর্মীয় ও হ সামাজিক জীবন আলােচিত হয়েছে। আকবরের আমলের ইতিহাস চর্চার ধারাবাহিকতায় আরাে একজনের নাম উচ্চারিত হয়। তিনি নিজামউদ্দিন আহমদ বখশি। তার রচিত গ্রন্থের নাম ‘তাবাকাত-ই-আকবরি এবং তাবাকাত- ই-আকবরশাহী। তিনি আকবরের সময়কাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করেছেন।
এই গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে তিনি তারিখ-ই-ইয়ামেনি, রওজাত-উস- সাফা, তাজুল মাসির, তাবাকাত-ই-নাসিরি, খাজাইনই-ফুতুহ, তুঘলকনামা, তারিখ-ই-ফিরােজশাহী, তারিখ-ই-মুবারকশাহী, ফুতুহুস সালাতিন, তুজুব-ই-বাবুরি, হুমায়ুননামা প্রভৃতি গ্রন্থের সহায়তা গ্রহণ করেছেন। আকবরের সময়কালেই আবদুল কাদের বদাউনি রচনা করেন মুস্তাখাব-উত-তাওয়ারিখ। বদাউনির এই ইতিহাস গ্রন্থটি নিজাম উদ্দিন আহমদ বখশির তাবাকাত-ই-আকবরর মতাে ভারতের মুসলিম শাসনের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস।
এতে গজনি রাজবংশ থেকে শুরু করে দিল্লিকেন্দ্রিক মুসলিম শাসনের সুলতানি আমলের পুরো সময় এবং মুঘল পর্বের সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের ৪০ বছরের ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। তবে মুঘল শাসনামলে নিজেদের ইতিহাসের পাশাপাশি ব্যতিক্রমী আফগানদের ইতিহাস রচনার প্রয়াসও লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিসেবে খাজা নেয়ামত উল্লাহ এবং আব্বাস খান শেরওয়ানির কথা বলা যায়। খাজা নেয়ামত উল্লাহ দীর্ঘ ৩৫ বছর সম্রাট আকবরের দরবারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন।
তিনি আফগানদের ইতিহাস রচনা করে তার পৃষ্ঠপােষক খানজাহানের নামে উৎসর্গ করেন এবং এর নামকরণ করেন তারিখ-ই-খানজাহানি ও মাখজানে আফগানি’। তারিখ-ই-খানজাহানি গ্রন্থে দিল্লির সুলতান বাহলুল লোদি থেকে শুরু করে ১০২১ হিজরি/১৫১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আফগানদের ইতিহাস আলােচিত হয়েছে। – এ ছাড়া শাইখ আলি শেরওয়ানির পুত্র আব্বাস খান শেরওয়ানি শেরশাহ সম্পর্কে ইতিহাস রচনা করে তার নামকরণ করেন তুহফাত-ই-আকবরশাহী।
এসব ইতিহাসবিদরা ছাড়াও আরাে বেশ কিছু ইতিহাসবিদের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা মুঘল যুগে প্রাদেশিক ইতিহাস চর্চায় উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন।
-লেখক, জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক