মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার একটি গ্রাম সাতঘরিয়া। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এ গ্রামে। ১০২ বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ডাচ ডেইরি লিমিটেড নামে একটি দুগ্ধ খামার। এ খামারে রয়েছে এক হাজারের বেশি দেশি ও বিদেশি গরু। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এ খামারটির যাত্রা ২০১৭ সালের অক্টোবরে।
দেশের বাজারে দুগ্ধশিল্পের বিকাশ ঘটাতে বদ্ধপরিকর এ খামারের স্বত্বাধিকারী। একই সঙ্গে উন্নত মানের দুধ উৎপাদন এ খামারের উদ্দেশ্য। খামারে দুধ দেওয়ার মতো প্রতিটি গাভী থেকে বছরে প্রায় সাত হাজার লিটার দুধ পাওয়া যায়। সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, বৃহৎ আকারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গরু পালন করা হয় এ খামারে।
খামারে প্রবেশের জন্য দর্শনার্থী ও সংশ্লিষ্টদের শরীরে জীবাণুনাশক কেমিক্যাল স্প্রে করতে হয়। খামারের অধিকাংশ গরু অস্ট্রেলীয় ফ্রিজিয়ান প্রজাতির। রয়েছে দেশি গরুও। এসব গরু পালন করা হয় কয়েকটি ধাপে। নানা শেডে রাখা হয় নানা ক্যাটেগরির গরু।
গবাদিপশুর উপযোগী বৈদ্যুতিক ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পশুগুলোর পায়ে যেন কোনো রোগ আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য আমদানি করা হয়েছে আরামদায়ক কার্পেট। জন্মের পর থেকে বাছুরকে রাখা হয় আলাদা প্ল্যাটফর্মে। এছাড়া গর্ভবতী গরুদের যত্নেও আলাদা জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে।
প্রথমে এ খামারে অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্স থেকে খাবার নিয়ে আসা হতো। কিন্তু এখন দেশীয় পদ্ধতিতে সব ধরনের খাবার খামারেই প্রস্তুত করা হয়। খামারে রয়েছেন দুজন পশু চিকিৎসক। প্রতিদিন গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ নানা বিষয়-আশয় দেখে থাকেন তারা। আরও জানা যায়, প্রযুক্তিনির্ভর এ খামারে অসুস্থ গরু চিহ্নিত করার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।
গরুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়েছে কি না তাও জানার সুযোগ রয়েছে, রয়েছে ‘মিলকিং পার্লার’। এ মেশিনের সাহায্যে একসঙ্গে ২৪টি গরুর দুধ দোহন করা যায়। এ পদ্ধতিটি বাংলাদেশের মধ্যে এখানে প্রথম চালু হয়েছে বলে জানিয়েছেন খামার সংশ্লিষ্টরা। খামার সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বাংলাদেশে দুগ্ধশিল্পের বিকাশ ঘটাতে ভূমিকা রাখবে এ খামারটি।
১০ বছরের মধ্যে এটি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে। খামারসংক্রান্ত প্রতিদিনের সব তথ্য কম্পিউটারাইজড করা হয়। তবে কিছু হতাশাজনক চিত্রও রয়েছে। যেমন প্রাথমিক ধাপে বিদেশ থেকে গরু আনার ক্ষেত্রে কোনো সরকারি সহায়তা পাওয়া যায়নি। অবশ্য পরে সংশ্লিষ্ট দফতর সহযোগিতা করেছে। খামার চালুর প্রায় আট মাসের মাথায় ২০১৮ সালের মে মাসে গরু আনা হয়। প্রথম দিকে ফ্রান্স থেকে ঘাস আনা হতো। নেদারল্যান্ডস থেকে আনা হতো অন্য খাবার। বর্তমানে ফার্মেই খাবার প্রস্তুত করা হয়। এখানে তৈরি সাইলেজ ও দানাদার খাবার খাওয়ানো হয়।
খামারের সার্বিক দেখাশোনা করেন গ্লোব ডেইরি ফার্মস লিমিটেডের সদস্য ও ডাচ ডেইরি ফার্মের পরিচালক মো. গিয়াস আহম্মদ। প্রায় ১৯ বছর ধরে ডেইরি ফার্ম ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন তিনি। ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কৃষি বিভাগে পড়াশোনা সম্পন্ন করে নেদারল্যান্ডসে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন ডেইরি ফার্মে পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। পাশাপাশি কয়েকটি সরকারি ফার্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
তিনি বলেন, খামারে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় এক হাজার গরু রয়েছে। গরুগুলোর জন্য রয়েছে ‘কাউ ম্যাট্রেস’। এটা দেখতে কার্পেটের মতো। এখানে চলাফেরা করলে গরুদের ব্যথা অনুভূত হয় না। ঘুমাতে সুবিধা হয়। পায়ে কোনো রোগব্যাধির আক্রমণ ঘটে না। ২৪টি গরু থেকে একসঙ্গে দুধ সংগ্রহ করা যায় আধুনিক মিল্কিং পার্লারের মাধ্যমে।
গরুদের বাসস্থানে বাতাস নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাদের শরীরে যেন ঠিকমতো বাতাস লাগে তা নিয়ন্ত্রণ হয় আধুনিক ফ্যান দিয়ে। বাছুরের খাবার তালিকায় দুধ না রেখে পর্যাপ্ত ডেনকাভিট মিল্ক রিপ্লেসার খাওয়ানো হয়। এটি নেদারল্যান্ডস থেকে আনা হয়। বাছুরকে ১২ সপ্তাহ ধরে এ খাবারটি দেওয়া হয়। জন্মের পর থেকেই আলাদাভাবে রাখা হয় বাছুরকে। গরুর জন্য সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করে থাকি আমরা।
খামারে সব মিলিয়ে দুই হাজার গরু পালনের পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। গরুকে ড্রাই ম্যাটার (সলিড খাবার) খাওয়ানো হয়। সলিড খাবার বলতে যেসব খাবার দেওয়া হয় সেখান থেকে পানি সরিয়ে ফেলা হয়। যেমন যে কোনো ঘাসে পানি থাকে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। এ খামারের গরুগুলো প্রচুর পরিমাণে ঘাস এবং ৮০ থেকে ৯০ লিটার পানি খেয়ে থাকে।
কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল ৬০টি গরু। বাংলাদেশে একটি ভুল ধারণা ছিল। এটা হলো, দেশে বিদেশি গরু পালনের পরিবেশ নেই। তাদের বাঁচানো যাবে না। আমিই প্রথম এ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছি। বলতে গেলে সব গরুকে বাঁচিয়েছি। বিদেশ থেকে আনা এসব গরু থেকে বেশি পরিমাণে দুধ পাওয়া যায় না।
এ রকম একটা ধারণাও ছিল। এ ধারণাটিও পাল্টে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক ফার্মের পরামর্শক হিসেবে আছি আমি। বাংলাদেশে গরু পালন করে এমন বহু খামার রয়েছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ফার্ম বলতে যা বোঝায় তাতে আমাদেরটিই প্রথম। হাইব্রিড গরু কীভাবে লালন-পালন করতে হয়, এ ব্যাপারে অনেকেরই অভিজ্ঞতা ছিল না।
আমরাই এ ব্যাপারটিতে পরিবর্তন এনেছি। সাফল্য পেয়েছি। ধীরে ধীরে গরুর সংখ্যা বাড়াচ্ছি। এখানে ব্রিডিং ফার্ম করা হবে। অনেকেই এখানে আসেন পরামর্শ নেওয়ার জন্য। মিল্কভিটা, রস মিষ্টান্ন ভাণ্ডারসহ স্থানীয় অনেক প্রতিষ্ঠান এ খামার থেকে দুধ সংগ্রহ করে।