Home Second Lead এক সময়ের অভাবী কৃষকদের এখন সুদিন

এক সময়ের অভাবী কৃষকদের এখন সুদিন

শহরে সবজি বেচে দলবেধে বাড়ি ফিরছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা। ছবি: আবু মুসা বিশ্বাস

 

  • ২০বিঘায় কলাচাষে প্রতিবছর  মুনাফা লক্ষাধিক টাকা
  • ৮ বিঘায় পেঁয়াজ চাষ করে বিক্রি ৫ লাখ টাকা

আবু মুসা বিশ্বাস

রাজবাড়ী:  ভোর চারটায় এদের দিনের কাজ শুরু হয়। কেউ কেউ আরও ভোরে ওঠে। আগের রাতে সব্জি জাতীয় ফসল তুলে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়। মান খারাপ হয়। টাটকা থাকে না,তাতে দাম কমে যায়। যেকারণে ভোরেই ফসল তুলে বস্তায় ভরতে (ঝাঁকা) করতে হয়।

এক সময় মূল পদ্মা নদী ছিলো পাবনা জেলার মধ্যে। রাজবাড়ীর সাথে পাবনা জেলাকে আলাদা করেছে পদ্মা নদী। পাবনার সুজানগর,বেড়া উপজেলার অধিকাংশ অধিবাসী রাজবাড়ী কেন্দ্রীক যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। নদী পার হলেই রাজবাড়ী শহর। সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার যাতায়াত। অন্যদিকে পাবনা শহরে যেতে সময় লাগতো ৬/৭ ঘণ্টা। তখন ঢালারচরের দুর্গম গ্রাম থেকে সুজানগর কিম্বা বেড়া উপজেলায় যাওয়া ছিলো দুঃসহ কষ্টের। এখন রাস্তাঘাট অনেক উন্নত হলেও রাজবাড়ীর সাথে নাড়ির টানের মতো যোগাযোগ অক্ষুণœ রেখে চলাচল করছে ওই এলাকার মানুষ।

জেলার সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের বসবাস করা কৃষকদের গ্রামের নাম চরকাঠুরিয়া,চরআম্বারিয়া,চরমৌকুড়ি, মালিকান্দা প্রভৃতি। পাশেই পাবনা জেলার বেড়া থানার ঢালারচর ইউনিয়ন। দুর্গম গ্রামগুলোর নাম দূর্গাপুর,আমিনপুর ছাইথুপি প্রভৃতি। রাজবাড়ীর হাটে আসা অর্ধেক কৃষকের বাড়ি পাবনা জেলার মধ্যে। সীমান্তবর্তী হওয়ায় দুই অঞ্চলের কৃষকরা এক হয়ে রাজবাড়ী হাটে ফসল বিকিকিনি করে।

রাজবাড়ী শহররক্ষা বাঁধ থেকে নদীর দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। বর্ষার সময় প্রায় ৫কিলোমিটার। মূল নদী রাজবাড়ী শহর ঘেঁষে থাকায় নদীর ওপার থেকে পাবনা ও রাজবাড়ীর একটি অংশের শতশত মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে রাজবাড়ীতে আসতে হয়।

প্রায় ২০-২৫ বছর হলো চর জেগে ওঠায় পলি-দোঁয়াশ মাটির কারণে যেকোন ফসলেরই বাম্পার ফলন হয়। ফলে এক সময়ের অভাবী কৃষকদের এখন সুদিন চলছে।

চৈতালী ফসল পিঁয়াজ-রসুন, কালাই, মটর, সরিষা থেকে শুরু করে, সব্জি জাতীয় ফসল পটল, উচ্ছে, বেগুন, লাউ, খিরা, মিষ্টি কুমড়ার আবাদ হয় ব্যাপক হারে। পাশাপাশি ধান-গম চাষ হয় বিপুল পরিমাণ জমিতে।

শুষ্ক মৌসুমে, বিশেষ করে শীত শেষে নগদপ্রাপ্তি অর্থকরী ফসল হিসেবে উৎপাদিত ফসল কৃষকের ঘরে এনে দেয় অপার শান্তি।

পাবনার ঢালারচর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক লালচাঁদ খান জানান,তার ৪ বিঘা জমিতে বেগুন ও পটল আবাদ করেছেন। বেগুনে মার খেলেও পটলে পুষিয়ে গেছে। রাজবাড়ী সদর উপজেলার আব্দুল কাদের মন্ডল বলেন, পিঁয়াজের মৌসুমে ৮ বিঘা জমিতে চাষ করে ৫ লক্ষ টাকা বিক্রি করেছে। একই এলাকার সিদ্দিক বিশ্বাস ২ বিঘা জমিতে পিঁয়াজ চাষ করে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় করেছে। অথচ তার খরচ হয়েছিলো ২৫ হাজার টাকা। চর মৌকুড়ি গ্রামের সামাদ সরদার জানান, তিনি ৫ বিঘা জমিতে উচ্ছে ও পটল চাষ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতে পেরেছেন।

এ এলাকার বেশিরভাগ কৃষক জানান, রাস্তাঘাট ও যানবাহনের অপর্যাপ্ততার কারণে যাতায়াতে অনেক খরচ চলে যায়। ছাইথুপি গ্রামের মৈজদ্দিন খাঁ জানান, একঝাঁকা (প্রায় দেড়মণ) পণ্য মাঠ থেকে রাজবাড়ী বাজার পর্যন্ত নিতে খরচ পড়ে ৯০ থেকে একশ টাকা। লেবার ও স্থানীয় পণ্যবাহী যানে (ভ্যান,অটো ও ঘোড়ারগাড়ি) মাল বহন করলে বাড়তি ব্যয়  বহন করতে হয়।

আরেক কৃষক দিদার মন্ডল বলেন, বষার্ মৌসুমে পণ্য পরিবহণ করা দুরূহ হয়ে ওঠে। তখন পুরো মাঠে পানি থকে। ধান-পাট-কাউন ছাড়া অন্য ফসল হয়না। তিনি জানান, এক ঝাঁকা পণ্য পার করতে ৫০টাকা ভাড়া দিতে হয় খেয়া নৌকায়। দূর্গাপুরের হোসেন বিশ্বাস আক্ষেপের সাথে জানালেন, ওই এলাকার প্রায় ৩০/৪০ বিঘা জমিতে বেগুনচাষ করে কৃষকরা বিপাকে পড়েছে। লকডাউনের কারণে কোথাও বেগুন বিক্রি করতে না পারায় ক্ষেতেই পচে নষ্ট হয়েছে মাঠের পর মাঠ। এই অল্প কিছুদিন আগে রোজা শুরু হলে কিছু লাভের আশা দেখছেন তারা। বৃষ্টি শুরু হলেই পণ্য  মাথায় করে (হেডলোড )নেয়া ছাড়া পথ থাকেনা। ফলে অনেক সব্জি জাতীয় ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।

সম্প্রতি এ চরাঞ্চলে কলাচাষের বিস্তার ঘটেছে। নানা জাতের কলা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কলাচাষিরা। শতশত বিঘা জমিতে কলাচাষ করছে স্থানীয় চাষিসহ শহরের অনেক শিক্ষিত লোক। স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে ৫ বছর কিম্বা আরও সময় নিয়ে জমির মালিকদের সাথে চুক্তি করে কলার চাষ করছে। কলাচাষি দুলাল মাস্টার জানান, ২০১২সালে ২০বিঘা জমিতে কলাচাষ করে তিনি প্রতি বছরে লক্ষাধিক টাকার প্রফিট করছেন। তবে কলার বাজারজাত করার বিষয়ে অন্য কৃষকদের মতো তিনিও একই সমস্যার কথা বললেন।

রাজবাড়ীর খেয়া ঘাটের ইজারাদার নুরুল ইসলাম ও ওয়াজ মন্ডল (সাব ঠিকাদার) বলেন, নদীভরা থাকলে কৃষিপণ্য পারাপারে কৃষকদের তেমন কষ্ট হয়না। কিন্তু নদী পানি কমতে থাকলে অনেক দূরে নৌকার ভিড়াতে হয়। ফলে কৃষিপণ্য মাথায় নিয়ে পানির পথ হেঁটে নৌকায় ওঠাতে হয়। তিনি জানান, এ মৌসুমে প্রতিদিন ৪/৫বার পারাপার করতে হয়।সব্জি জাতীয় পণ্য ভোর থেকে পারাপার করেন। রাজবাড়ী বাজারের আড়তে সকাল ৮টার মধ্যে না পেীঁছালে ভালো দাম পাওয়া যায়না।

রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ বাহাউদ্দিন জানান, এ ঊর্বর চরাঞ্চলের মৌসুমি পণ্য রাজবাড়ীর মানুষের সব্জির চাহিদাসহ বিপুল পরিমাণে পিঁয়াজ-রসুনের যোগান দেয়।  জানান,চরাঞ্চলের কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে ভর্তুকি মূল্যে সরকারিভাবে ট্রাক্টর সরবরাহ করা হয়েছে। সব্জি জাতীয় ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল হচ্ছে পটল ৩২হেক্টর ,উচ্ছে ১ হেক্টর বেগুন ৪ হেক্টর, ঝিঙে ২ হেক্টর, শশা ২ হেক্টর এবং বাদাম ২০০ হেক্টর।  তাদের আরও সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন বলে  অভিমত প্রকাশ করেন।

কৃষকরা পণ্য বিক্রি করে ঘাম ঝরানো কষ্টকে ঝেড়ে ফেলে রাজবাড়ী শহরের মিষ্টির দোকান থেকে গরম জিলেপি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর ছাড়তে ছাড়তে ফিরতি খেয়া নৌকায় যখন দলবেধে ঘরে ফেরে তখন তাদের মতো সুখি মানুষ আর দ্বিতীয়টি আছে কীনা ভবতেই অবাক লাগে।