Home অন্যান্য এক ‘সুখোমাসি’র দিনকাল

এক ‘সুখোমাসি’র দিনকাল

সুখোমাসি

নয়ন দাস: জীবে দয়া করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’- অজ্ঞাতসারে এই মন্ত্রে দীক্ষিত ‘সুখো মাসি’কে আজ অসহায়ভাবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

কুড়িগ্রামের বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম পশ্চিম সাতভিটায় বসবাস করেন ষাটোর্ধ্ব পশুপ্রেমী ‘সুখো মাসি’। কৈশোর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও স্বাধীনভাবে বাঁচতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্স না দিয়েই স্বামীর বাড়ী থেকে চলে আসেন ভাইয়ের বাড়িতে। প্রচলিত নিয়মে স্বামীটি অন্য কোথাও বিয়ে করলেও মাসি’র কোন ভ্রূক্ষেপ ছিল না সেদিকে। নিঃসন্তান এই মানুষটি ভাইয়ের সংসারে বোঝা হয়ে থাকতে চাননি বলেই চলে আসেন পশ্চিম সাতভিটা গ্রামে অর্থাৎ উনার বোনের স্বামীর বাড়ীতে। সেই গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় তাকে ভালো করেই চেনার সুযোগ হয়েছে আমার। গ্রামের আমরা সবাই তাকে মাসি বলেই ডাকি।

এখন তার সম্বল বলতে দুটো ছাগল আর ছনের জীর্ণ একটি ঘর। বাবা মা ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন সুখো। সত্যিই নামটি তার জন্য যথার্থ। কেননা অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। অন্যের কাজ করে দিয়ে (একটিই কাজ তার তা হলো ৪০/৪৫ কেজি ধানের বস্তা মাথায় করে নিয়ে মিল থেকে ধান ভানে আনা) একবেলা একমুঠো খেয়ে বা না খেয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করেন “সুখো মাসি”। তবুও তার মাঝে সুখের কমতি ছিল না।

সবসময়ই তার মধ্যে শুচিবায়ু স্বভাব। পুকুর কিংবা ডোবায় কখনো স্নান করেন না তিনি। তার বিশ্বাস পুকুর বা ডোবার পানিতে বর্জ্য আছে। প্রায় ১ কি.মি. হেঁটে নদীতে গিয়ে স্নান করেন।

সেই শুচিবায়ু স্বভাবের সুখো মাসি’র পশুপ্রীতি সবাইকে অবাক করে দেওয়ার মতো। রাতে নিজের বিছানায় ছাগলকে শোয়ানো, নিজের খাবারটুকু ভাগাভাগি করে খাওয়া এবং ছাগলকে একবেলা খেতে দিতে না পারলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে তার সাথে কথা বলা। যা সত্যিই অবাক করার মতো। এভাবেই আস্তে আস্তে ছাগলগুলোও তার খুব কাছের হয়ে গেছে। ছাগলগুলো যেন তার ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছে। তার আদরে আপ্লুত হয়ে মুখ লুকাচ্ছে তার বুকে।

শুধু যে তার নিজের গৃহপালিত পশুর প্রতি এমন দরদ,তা নয়। যে কারো গৃহপালিত পশুর প্রতি তার অকৃত্রিম স্নেহ ও দরদের কথা গ্রামবাসী জানেন। সুযোগ পেলেই তার সমস্ত ভালোবাসাই যেন বিলিয়ে দেন এই পশুগুলোর জন্য। সত্যিই এমন দৃষ্টান্ত বিরল। কয়েক দিন থেকে ঘন ঘন বৃষ্টি হওয়ার কারণে ঘরে থাকাই দায় হয়ে গেছে তার। যেন জীর্ণ ছনের ঘরের সুখের জীবনে এই ঘন বৃষ্টি ভাগ বসিয়েছে। “বাবা ঝড়ি আইলে ঘরোত শুতি থাকপের না পাং গাও ভিজি যায় পানিত্। খ্যাতা গাত দিয়ে বসি থাকোং টংঙ্গোত। ঠান্ডাতে টুটটুরা নাগোং কোনো কোনো দিন ঠান্ডা খায়া জ্বরও অাইসে।কাই এ্যালা মোক ঘর কোনা ঠিক করি দেয়। মোর নাই দুই বেলা খাওয়ার কিছু। মুই ক্যামোন করি ঘর কোনা ঠিক করিম সেই চিন্তেতে বাচোং না”- অসহায় কান্না বিজড়িত কন্ঠে এই কথাগুলো তিনি বলেন।

কথা বলে আরও জানা যায় যে, ষাটোর্ধ্ব বয়সেও তিনি যেমন পাননি কোন ভিজিএফ বা রেশন কার্ড, তেমনি পাননি বিধবা ভাতা বা বয়স্ক ভাতা। জানতে চেয়েছিলাম কেন পাননি তিনি এগুলো। তার ভাষ্য, তোষামোদের এই যুগে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা না দেওয়ায় বা তাদের তোষামোদ না করার জন্যই তিনি এগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কেউ তার খোঁজখবর রাখেননি বলেও তিনি জানান। এমতাবস্থায় গ্রামবাসীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যেন তার দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া হয় এবং তার পশুপ্রেমী জীবন আবারও কিছুটা অনটনমুক্ত হয়।