বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
আজ থেকে ৯ বছর আগের এই সময়ের কথা অনেকেরই মনে আছে। সদ্য খবর এসেছে এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার (MH 370)। ২৩৯ জন যাত্রীর কেউ জীবিত নেই বলে মনে করা হচ্ছে। যাত্রীদের পরিবার ছুটে এসেছে দুর্ঘটনার স্থলে। আশা, ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হবে বিমানের (Flight Missing)। যদি কোনও ভাবে কোনও মিরাকেল ঘটে…
মিরাকেলই ঘটেছিল অবশ্য শেষমেশ, তবে একেবারে অপ্রত্যাশিত এক আঙ্গিকে। চিরতরে নিখোঁজ হয়ে গেছিল আস্ত বিমানটি (Mystery)। এমন ঘটনা কখনও দেখেনি বিশ্ববাসী। একাধিক দেশের যৌথ তৎপরতায় দীর্ঘদিন ধরে আঁতিপাতি করে সন্ধান চালানো হলেও, হদিস মেলেনি সে বিমানের একটি টুকরোরও। দুর্ঘটনায় হতাহত যাত্রী, বিমানের ধ্বংসাবশেষ এমনকি ব্ল্যাকবক্স– সবসুদ্ধ যেন স্রেফ গায়েব হয়ে যায় বিমানটি। চরম রহস্যে হতবাক হয়ে যায় গোটা দুনিয়া।
২০১৪ সালের ৯ মার্চ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের এমএইচ ৩৭০ বিমানের অন্তর্ধান রহস্য আজও পৃথিবীর গভীরতম অমীমাংসিত রহস্যগুলির মধ্যে একটা। বোয়িং ৭৭৭ বিমানটি যেন শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছিল সেদিন। কীভাবে কী হল, কোনও সূত্রই বার করতে পারেনি পৃথিবীর তাবড় সব অনুসন্ধান সংস্থা। আজ ৯ বছর হয়ে গেল, ফলাফল শূন্য। এভাবে কোনও রকম সূত্র না রেখে, কার্যত ভৌতিক ভাবে একটি বিমানের চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা মনে করলে আজও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান অনেকে।
সব ঠিক আছে, শুভরাত্রি
৮ মার্চ রাত ১২টা ৪১ মিনিটে, কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে ২২৭ জন যাত্রী ও ১২ জন ক্রু সদস্য নিয়ে উড়ে যায় এমএইচ৩৭০। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ১৫৩ জন চাইনিজ, ৩ জন আমেরিকান, ৬ জন অস্ট্রেলিয়ান, ২ জন কানাডিয়ান, ৪ জন ফরাসি, ২ জন ইউক্রেনিয়ান, ৫ জন ভারতীয়, ৭ জন ইন্দোনেশিয়ান, ২ জন ইরানি এবং ১ জন করে রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, হংকং ও তাইওয়ানের বাসিন্দা।
ভোর সাড়ে ছ’টায় বেজিং পৌঁছনোর কথা ছিল সেটির। কিন্তু উড়ানের ঠিক এক ঘণ্টা পরেই বিমানটির সঙ্গে কন্ট্রোল অফিসের সমস্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, তার আগে পর্যন্ত কোনও রকম বিপদ সঙ্কেত বা বিশেষ বার্তা কিছুই আসেনি। বরং পরে জানা যায়, রাত ১টা ১৯ মিনিটে শেষ বার্তা এসেছিল কো-পাইলটের তরফে। তিনি বলেছিলেন, “সব ঠিক আছে, শুভরাত্রি।”
শেষ যোগাযোগ
কো-পাইলটের বার্তা আসার ঠিক দু’মিনিট পরে, রাত ১টা ২১ মিনিটে ভিয়েতনামের দক্ষিণে কামাউ আকাশসীমায় প্রবেশ করার পরে বিমানটির সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের। সেই সময় বিমান ছিল ৩৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে অবধি কন্ট্রোল রুমে কোনও বার্তা বা সঙ্কেত কিছুই আসেনি। যা একরকম ভাবে নিশ্চিত করে, যান্ত্রিক কোনও ত্রুটি তখনও পর্যন্ত ছিল না বিমানে।
সাধারণত, দুর্ঘটনার আশঙ্কা ঘটলে বা কোনও রকম বিপদ বুঝলে, যোগাযোগ করার সময় না থাকলে পাইলট কন্ট্রোল রুমে ‘মে ডে’ সঙ্কেত পাঠায়। বিমানের পরিভাষায় এই মে ডে সঙ্কেতের অর্থ হল, ‘সাহায্য চাই’। এই ধরনের আপৎকালীন সঙ্কেতও আসেনি এমএইচ৩৭০ থেকে।
যে পাইলট চালাচ্ছিলেন বিমানটি
দুর্ঘটনার দিন বিমানের চালক ছিলেন ৫৩ বছর বয়সি জাহারে আহমদ শাহ। তাঁর সফল ভাবে ১৮ হাজার ঘণ্টা আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা ছিল। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি বিমান চালাচ্ছেন। অত্যন্ত দক্ষ পাইলট ছিলেন তিনি। সেদিন কো-পাইলট হিসেবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ২৭ বছরের তরুণ পাইলট ফারিক হামিদ। তিনি ২০০৭ থেকে পাইলট ছিলেন। ২৮০০ ঘণ্টা উড়ানের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর।
যোগাযোগ হারানোর পরে
নিখোঁজ এমএইচ৩৭০-র সন্ধানে আমেরিকা, চিন, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম– এতগুলি দেশ উদ্ধার অভিযানে সেরা দল পাঠায়। কিন্তু ফলাফল শূন্য। বিমানটির খোঁজে ২৭ হাজার বর্গ নটিক্যাল মাইল এলাকাজুড়ে তন্নতন্ন করে খোঁজ চলে। ১২টিরও বেশি দেশ সম্মিলিত ভাবে চেষ্টা করে বিমান খোঁজার। মালাস্কা প্রণালী ও চিন সগারজুড়ে কার্যত চিরুনি তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু একটি টুকরোও মেলে না।
উদ্ধার অভিযানের ক্যালেন্ডার
কোন পথে এগিয়েছিল নিখোঁজ বিমানের খোঁজ, তা আরও একবার মনে করে নেওয়া যাক।
৯ মার্চ, ২০১৪: থাইল্যান্ডের গালফ এরিয়া থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু হওয়ার পরে বিমানটির শেষ সংযোগ মেলা জায়গায় সমুদ্রের জলে তেল মিশে থাকতে দেখা যায়। মনে করা হয়, সেটি বিমানটির জ্বালানি। সেখানেই ভেঙে পড়েছে বিমান। খোঁজ চলে জোরদার। কিন্তু ল্যাবে পরীক্ষা করে জানা যায়, ওই তেল আসলে জাহাজ থেকে পড়েছে। ফলে আবারও শূন্য থেকে শুরু।
১০ মার্চ, ২০১৪: বিমান ভেঙে পড়ার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে হংকংকে শনাক্ত করার পরে চায়নার দক্ষিণ মধ্যসাগর পর্যন্ত বাড়ানো হয় বিমান খোঁজার পরিধি। এদিন জানা যায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর। বিমানের যাত্রীদের মধ্যে দু’জনের পাসপোর্ট ছিল জাল। ফলে ধারণা করা হয়, নিছক দুর্ঘটনা নয়, হয়তো কোনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রয়েছে এই রহস্যের পেছনে।
১১ মার্চ, ২০১৪: দু’জন সন্দেহভাজনের সঙ্গে কোনও সন্ত্রাসী সংগঠনের সংযোগ ছিল না বলেই জানিয়ে দেন গোয়েন্দারা।
১২ মার্চ, ২০১৪: দক্ষিণ চিন সাগর এবং থাইল্যান্ডের গাল্ফ সাগরের মাঝামাঝি ভেসে থাকা কিছু ধ্বংসাবশেষের ছবি ধরা পড়ে চিনের উপগ্রহ চিত্রে। কিন্তু সে ছবি দেখার পরে মালয়েশিয়া সরকার জানিয়ে দেয়, সেগুলি এমএইচ ৩৭০-র অংশ নয়।
১৩ মার্চ, ২০১৪: তদন্তে জানা যায়, কন্ট্রোল অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরেও আরও চার-পাঁচ ঘণ্টা বিমানটি আকাশে ছিল। ফলে অনুসন্ধানকারী দল ধারণা করে, বিমানটি মালয় উপদ্বীপ ঘুরে পশ্চিম দিকে চলে গেছে। সেই মতো ভারত মহাসাগরেও খোঁজ শুরু হয়। আমেরিকা বিশেষ দল পাঠায় এ কাজে।
১৪ মার্চ, ২০১৪: এমন একটি তথ্য সামনে এল, গোটা ঘটনার একটি নতুন মোড় খুলে গেল। আমেরিকার একটি সংবাদমাধ্যমে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। তাতে দাবি করা হয়, রাডারের সঙ্গে শেষ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরপরই বিমানটি পর্যাপ্ত উচ্চতায় থাকার ক্ষমতা হারায়। বিমানের পাইলটদের অসতর্কতা বা কোনও ত্রুটির কারণেই এমনটা ঘটেছে বলে দাবি করেন তাঁরা।
১৫ মার্চ, ২০১৪: বিমান থেকে পাওয়া সিগন্যালগুলি খতিয়ে দেখার কাজ করছিল বিশেষ তদন্তকারী টিম। তারা রিপোর্ট দেয়, সব দেখে মনে হচ্ছে, বিমানটি উত্তরে মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর এবং পূর্বে অস্ট্রেলিয়া– এই পরিধির মধ্যে কোথাও আছে। তবে এই দিন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রজ্জাক এক নতুন তথ্য ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে বিমানটির গতিপথ বদলে দিয়েছে।”
১৬ মার্চ, ২০১৪: তদন্তকারীরা জানান, চার-পাঁচ ঘণ্টা নয়, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে সাত ঘণ্টা উড়েছিল বিমানটি। ফলে অনুসন্ধানের অভিমুখ বাড়ানো হল ভারত সাগর পর্যন্ত।
১৯ মার্চ, ২০১৪: অনুসন্ধান অভিযানে যোগ দিল আমেরিকার সর্বোচ্চ তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন অর্থাৎ এফবিআই। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ ও তদন্ত শুরু করে তারা। সামনে আসে আরও অদ্ভুত এক তথ্য। বিমান সংক্রান্ত কিছু ডেটা নাকি উধাও! তবে সে সব ডেটা ফেব্রুয়ারি মাসের। সেই সঙ্গে জানা যায়, বিমানটিতে কতটা জ্বালানি ছিল তার নির্দিষ্ট পরিমাণ। সেটা হিসেব করে অনুসন্ধানের পরিধি খানিকটা কমিয়ে আনা হয়।
২২ মার্চ, ২০১৪: চিনের উপগ্রহ চিত্রে আবারও ধরা পড়ে, ভারত মহাসাগরের দক্ষিণাংশে প্রায় ৭৫ ফুট দীর্ঘ কিছু একটা পড়ে রয়েছে। তবে স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পড়া ওই এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েও কোনও ধ্বংসাবশেষ মেলেনি।
২৩ মার্চ, ২০১৪: ফ্রান্সের স্যাটেলাইট ইমেজেও ধরা পড়ে একটি ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আবারও ব্যর্থতা।
২৪ মার্চ, ২০১৪: মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করেন, বিমানটি ভারত মহাসাগরের দক্ষিণেই ডুবে গেছে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে আর চালানো যাবে না অনুসন্ধান।
৪ এপ্রিল, ২০১৪: বেশ কয়েক দিন পরে, চিনের একটি সাবমেরিনের রাডারে একটি নির্দিষ্ট শব্দ শনাক্ত হয় ভারত মহাসাগরের তলদেশ থেকে। সে শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি পরীক্ষা করে তদন্তকারীরা প্রায় ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত হয়ে যান, বিমানের ব্ল্যাকবক্স থেকেই আসছে সেই শব্দ।
১৪ এপ্রিল, ২০১৪: সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় সাবমেরিন ‘দ্য ব্লুফিন ২১’ পাঠানো হয় সমুদ্রের তলদেশে, ৩৫ মাইল গভীরে। কিন্তু সবাইকে চরম বিস্মিত ও হতাশ করে, আবারও খালি হাতে ফিরে আসে সাবমেরিনটি।
সামরিক মহড়ায় গুলি খেয়ে ভেঙে পড়ে বিমান!
তবে উদ্ধারকাজ বন্ধ করা হচ্ছে না বলেই ঘোষণা করা হয়। অনুসন্ধানকারী দলের তরফে। কাজ চলতে থাকে নিঃশব্দে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তানজানিয়া, মরিশাস ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে ধ্বংসাবশেষের খোঁজ মেলার খবর আসে। কিন্তু কোনও বারই তা এমএইচ ৩৭০-র ছিল না বলে জানা যায়।
২২ জুলাই, ২০১৬: মালয়েশিয়া, চিন ও অস্ট্রেলিয়া যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার বন্ধ করা হবে অনুসন্ধান। ইতিমধ্যে আমেরিকার এক সাংবাদিক নাইজেল ক্যার্থন একটি বই লেখেন, ‘ফ্লাইট এমএইচ ৩৭০: দ্য মিস্ট্রি’। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, আমেরিকা-তাইল্যান্ডের যৌথ সামরিক মহড়া চলার সময়ে গুলি লাগে বিমানটির গায়ে। চিন সাগরে ভেঙে পড়ে সেটি। যদিও এই দাবির কোনও সত্যতা আজও প্রমাণিত হয়নি।
শেষমেশ বন্ধ অমীমাংসিত ফাইল
প্রায় তিন বছর পরে, ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি ঘোষণা করা হয় অনুসন্ধান বন্ধ হয়েছে সবরকম ভাবে। তার পর থেকে আর খবরের শিরোনামেও আসে না এই বিমান। এভাবেই পেরিয়ে গেল ন’টা বছর। পেরিয়ে গেল আরও একটি ৯ মার্চ। বিমানের ২৩৯ জন যাত্রীর পরিবারের সদস্যদের কান্নাতেই এখন মিশে রয়েছে এই বিমান।
কোনও সূত্র না রেখে, একটি আস্ত বিমানের শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার রহস্য আজও হার মানায় যে কোনও ভৌতিক কাহিনিকে।