শায়খ ড. আবদুল বারি বিন আওয়াদ আস সুবাইতি
পবিত্র কোরআনুল কারিম মহিমান্বিত রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআনের মাধ্যমে এ উম্মত উত্তম নীতি-নৈতিকতা, আচার-আচরণ ও জীবনের অন্যান্য বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। আসমান থেকে অবতীর্ণ বিষয়াদির মধ্যে কোরআনুল কারিম সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অলৌকিক বিষয়। কোরআনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হলো, এর প্রতি অন্তরের অপার্থিব টান অনুভূত হয়; হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে। কোরআনুল কারিমের তেলাওয়াত অন্তরে আনন্দণ্ডভয়, প্রশান্তি, বিশ্বাস এবং নিরাপত্তা বিধান করে। এ বরকতময় মাসে কোরআনুল কারিম অবতীর্ণের উদ্দেশ্য হলো, সিয়াম সাধনার কারণে অন্তরে আল্লাহভীতি আসে। অন্তর থেকে অযাচিত কামনা-বাসনা দূর হয়। হৃদয় পরিশুদ্ধ হয়। ফলে কোরআন তেলাওয়াত করা এবং শ্রবণের প্রতি অন্তরের আগ্রহ এবং প্রস্তুতি বেশি থাকে। তাই এর তেলাওয়াত আমাদের দেহে প্রভাব বিস্তারকারী। লোম দাঁড়িয়ে যায়। অন্তর প্রশান্ত হয়। এ কারণে বান্দা কোরআনের জ্ঞানার্জন, সে অনুযায়ী আমল এবং আনুষঙ্গিক বিষয় হাসিল করতে কোরআনের প্রতি ধাবিত হয়।
রমজান কোরআন তেলাওয়াতের মাস
রমজান হচ্ছে অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াতের মাস। যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোরআনকে নিজের জন্য আবশ্যক হিসেবে মেনে নিয়ে সর্বদা সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করে, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অগণিত নেয়ামত ও বরকত রয়েছে। কোরআনুল কারিম তেলাওয়াতের উদ্দেশ্য যদি হয় তার থেকে উপদেশ গ্রহণ করা, আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেওয়া এবং শাস্তির ব্যাপারে ভয় করা, তাহলে কোরআনই তার মুক্তির জন্য যথেষ্ট। এমন ব্যক্তি সম্পদ ছাড়াও ধনী; নিজস্ব জনবল ছাড়াও মর্যাদাবান।
কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত
রমজান এবং অন্যান্য মাসে কোরআনুল কারিম তেলাওয়াত ও এর আনুগত্য ঈমান বৃদ্ধি করে। আত্মাকে পরিশুদ্ধ ও আলোকিত করে। মৃত হৃদয়কে পুনরুজ্জীবিত এবং তাতে জীবন দান করে। রমজান মাসে কোরআনপ্রেমীরা সালাতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে মধুময় কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ হয়। আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন উপভোগ করে। তারা আল্লাহর কালাম শ্রবণে ক্লান্ত হয় না। কোরআন তেলাওয়াতকারী কোরআনে বর্ণিত নির্দেশনাগুলো নিজের অন্তরে ধারণ করে। কেননা, কোরআন হচ্ছে আলো, চিন্তাশক্তির আত্মা, সঠিক পথনির্দেশক, ভালো-মন্দের বিভাজনকারী, অসুস্থতার নিরাময়, আল্লাহর স্মরণ ও রহমত-বরকতের গ্রন্থ। কোরআন থেকে ভালো বিষয়গুলো তারাই অর্জন করতে পারে, যারা কোরআন নিয়ে গবেষণা করে; এর অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। জবান কোরআনুল কারিম তেলাওয়াত করে, মন অনুবাদ করে এবং অন্তর তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে। কোরআনুল কারিম এর তেলাওয়াতকারীকে আল্লাহর রাজত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব এবং সৃষ্টিজগতে আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এভাবে আল্লাহর মহত্ত্ব, বড়ত্ব, কারুকার্য, শক্তি এবং অলৌকিকতা সম্পর্কে জ্ঞান বেড়ে যায়। এর প্রভাবে অন্তরে কোমলতা আসে। মুসলমান আল্লাহকে ভয় ও মহব্বতের সঙ্গে অনুসরণ করা আরম্ভ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে একটি নিদর্শন হলো, তিনি মাটি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। এখন তোমরা মানুষ, পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছ।’ (সুরা রুম : ২০)।
কোরআন ঈমানকে জাগ্রত করে
কোরআন তার শ্রোতা ও পাঠককে সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা আপ্লুত করে ঈমান জাগিয়ে তোলে। কোরআনের প্রতিটি সুরা আমাদের ঈমানকে প্রচণ্ড পরিমাণে দৃঢ় করে। ঈমান শুধু আবেগ ও অনুভূতির নাম নয়, বরং এর ঘোষণা এবং কর্মে ঈমানের বাস্তবতা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনদের বক্তব্য শুধু এ কথাই, যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে তাদেরকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম ও আদেশ মানলাম। তারাই সফলকাম।’ (সুরা নুর : ৫১)। কোরআনের আয়াতগুলো আমাদের অন্তরকে নাড়া দিতে থাকে। এর মাধ্যমে আমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত এবং আশীর্বাদের তালিকা জানতে পারি। আল্লাহ আমাদের জন্য রাতদিনকে নির্ধারণ করেছেন। উজ্জ্বল সূর্য দান করেছেন। আলোকিত চাঁদ দিয়েছেন। নিজ কক্ষপথে তারকারাজি সৃষ্টি করেছেন। পাকা ফল ও ফসল দান করেছেন। আল্লাহর নেয়ামত আমাদের ওপর অগণিত; যা গুনে শেষ করা যাবে না। তারাই আল্লাহর এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই এতে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নাহল : ১২)।
রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত
কোরআনুল কারিমের আয়াতগুলো আমাদেরকে আল্লাহর প্রশস্ত রহমত, তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমা এবং বিশাল উদারতার জ্ঞানার্জনে সাহায্য করে। রমজান মাসে যখন সিয়াম পালন এবং কোরআনুল কারিমের তেলাওয়াত একত্রিত হয়, তখন সেখানে আল্লাহর রহমতের বারি বর্ষিত হতে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার : ৫৩)।
কোরআন ক্ষমা প্রার্থনা ও রহমত লাভের আহ্বান করে
আল্লাহতায়ালা বান্দার সব গোনাহ মাফ করে দেন, যখন সে তার কৃত অন্যায়ের প্রতি অনুতপ্ত হয় এবং সেখান থেকে তওবা করে ফিরে আসে। কোরআনুল কারিমের আয়াত আমাদেরকে আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা এবং তার রহমত ও বরকত লাভ করার ব্যাপারে প্রার্থনার আহ্বান জানায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, অথচ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করি। কাজেই আমার আদেশ মানা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৬)।
কোরআন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে
কোরআনের আয়াতগুলো বিচার দিনে নির্যাতিতদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম করা হবে না। যদি কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব। হিসেব গ্রহণে আমিই যথেষ্ট।’ (সুরা আম্বিয়া : ৪৭)। কোরআনে আল্লাহ?তায়ালা শয়তানের স্বরূপ, তার ষড়যন্ত্র, ইতিহাস, তার ধোঁকা দেওয়ার কৌশল বিষয়েও আলোচনা করেছেন। শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে সুরক্ষা করার উপায়ও বাতলে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা ও তাঁর কালামে পাকের প্রতি বিশ্বাসীরা এগুলো থেকে নিজেদের আশ্বস্ত করে।
কোরআন ইতিহাস বর্ণনা করে
কোরআন ইতিহাস বর্ণনা করে। এর মাধ্যমে আগেকার জাতিগুলোর অবস্থা, তাদের বিশ্বাস, অগ্রগতি ও নীতি-নৈতিকতার স্তরে আরোহণের কারণসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি ফুটে উঠেছে। তাদের পতন ও অবতরণের কারণগুলোও উল্লেখ করেছে। পূর্ববর্তীদের খারাপ চরিত্র, রাসুলদের সঙ্গে তাদের আচার-ব্যবহার এবং এ সংক্রান্ত আলোচনা বিশ্বাসীদের জন্য উপদেশস্বরূপ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এ হচ্ছে কয়েকটি জনপদের সামান্য ইতিবৃত্ত; যা আমি আপনাকে শোনাচ্ছি। এর মধ্যে কোনো কোনোটি এখনও বর্তমান আছে, আর কোনো কোনোটির শিকড় কেটে দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা হুদ : ১০০)।
কোরআন নাস্তিকদের জবাব দিয়েছে
কোরআনে নাস্তিকদের যুক্তির জবাব, তাদের মতামত ও সন্দেহ খণ্ডনবিষয়ক অনেক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি আপনা-আপনিই সৃজিত হয়ে গেছে নাকি নিজেরাই স্রষ্টা? নাকি তারা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না।’ (সুরা তুর : ৩৫-৩৬)।
বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কোরআন পদক্ষেপ নিয়েছে
সব সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার কথাও আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে কিংবা তাদের হস্তপদগুলো বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে বা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা, আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা মায়িদা : ৩৩)।
কোরআন পার্থিব জীবনের অবস্থা বর্ণনা করে
কোরআনুল কারিম পার্থিব জীবনের বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করে। প্রয়োজন মতো এর সঠিক মূল্যায়ন করে। কোরআন দুনিয়াবি মজা-মাস্তিতে নিমগ্ন আত্মাকে বাস্তব নির্দেশনা দেয়। অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তোলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে রাসুল!) তাদেরকে বলে দিন, পার্থিব ফায়দা সীমিত। আর পরকাল পরহেজগারদের জন্য উত্তম। তোমাদের অধিকার একটি সুতা পরিমাণও খর্ব করা হবে না।’ (সুরা নিসা : ৭৭)। কোরআনের আয়াতে শিল্প, বাগ্মিতা, উপস্থাপনা এমনভাবে চিত্রিত হয়েছে, যা শেষ দিবস সম্পর্কে অন্তরের তালা খুলে দেয়। যাতে শেষ দিবসের বাস্তব চিত্র আমাদের অন্তরে সারাক্ষণ ধারণ করে রাখতে পারি। বিবেকবোধ জাগ্রত করতে পারি। কোরআনের আয়াতগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কেয়ামতের দিবসে আমাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সাক্ষী দেবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যখন জাহান্নামের কাছে পৌঁছাবে, তখন তাদের কান, চোখ ও ত্বক তাদের কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে।’ (সুরা ফুসসিলাত : ২০)।
কোরআনে জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা রয়েছে
কোরআন জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসীদের ব্যাপারে আলোচনা করে। জান্নাতের বর্ণনা এমনভাবে দেয় যে, মানুষের অন্তরে আনন্দ অনুভূত হয়। মনে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। আত্মা সেই মহান দিনের অপেক্ষায় থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্বর্ণখচিত সিংহাসনে তারা পরস্পর মুখোমুখি হয়ে হেলান দিয়ে বসবে। পানপাত্র, কুঁজা ও খাঁটি শূরাপূর্ণ পেয়ালা হাতে চির কিশোর দল তাদের কাছে ঘোরাফেরা করবে, যা পান করলে তাদের শিরঃপীড়া হবে না। তারা বিকারগ্রস্তও হবে না। আর তাদের পছন্দমতো ফলমূল ও পছন্দের পাখির গোশত নিয়ে তারা ঘোরাফেরা করবে। সেখানে থাকবে আবরণে রক্ষিত মোতিতুল্য আনত নয়না হুররা।’ (সুরা ওয়াকিয়া : ১৫-২৩)।
৭ রমজান ১৪৪৩ (৮ এপ্রিল ২০২২) মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আল মামুন নূর