বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। এবার চা বাগানের ত্রাস সৃষ্টিকারী লুপার, হ্যালোপেলটিস, গ্রীন ফ্লাই কিংবা রেড স্পাইডারের মতো রোগপোকাকে দমন করবে সাইকানাস, লেডি বার্ড বিটেল কিংবা গ্রীন লেস উইং নামে অন্য পোকারা। যা ইতিমধ্যেই ভারতের অসমের জোড়হাটের টোকলাইতে অবস্থিত দেশের শতাব্দী প্রাচীন চা গবেষণা কেন্দ্র (টিআরএ) তাদের গবেষণাগারে তৈরি করে ফেলেছে। পরীক্ষামূলকভাবে ক্ষতিকর পোকা ভক্ষণে ওই শিকারি পোকাদের (প্রিডেটার্স) ব্যবহার টিআরএ শুরুও করেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চা বাগানে রাসায়নিকের পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবে রোগপোকা দমনের এই নয়া পন্থা বাস্তুতন্ত্রের নিরিখে যুগান্তকারী হয়ে উঠতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। টিআরএ এই নয়া প্রকল্পটির নাম দিয়েছে ইকোলোজিকাল হেভেন। সংস্থার-র চেয়ারপার্সন নয়নতারা পালচৌধুরী বলেন, ‘জলবায়ুর আমুল পরির্বতন হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কুফল এসে পড়ছে কৃষি ভিত্তিক চা শিল্পেও। যে কারণে গবেষণার মাধ্যমে শিল্প বান্ধব নানা ধরনের উদ্ভাবন এখন সময়ের চাহিদা হয়ে পড়েছে। এজন্য টিআরএ-র বিজ্ঞানীরা সর্বোতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পোকা দিয়ে পোকা দমন এই পরিকল্পনারই অঙ্গ।‘
চা বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃঙ্খলের পুরোনো নীতিকেই চা গাছের রোগপোকা দমনে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। খাদ্যশৃঙ্খলে উৎপাদককে (সবুজ গাছ) প্রথম সারির খাদক, আবার প্রথম সারির খাদককে পরের ধাপের দ্বিতীয় সারির খাদকরা ভক্ষণ করে। চায়ের ক্ষেত্রে লুপার, হ্যালোপেলটিস বা রেড স্পাইডারকে নিকেশ করবে সাইকানাস, লেডি বার্ড বিটেলের মতো অন্য পোকার দল। উপকারী ওই সমস্ত পোকা প্রকৃতিতেও আছে। তবে গবেষণাগারে তৈরি করে পোকার সংখ্যাকে মাল্টিপল করা বা বাড়ানোই টিআরএ-র উদ্দেশ্য। এখন মূলত রাসায়নিক দিয়ে ক্ষতিকর পোকা দমন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় লুপারদের হানাদারি শুরু হলেই বাগানগুলি সেগুলির খাদকদের পরিপূর্ণতার জন্য অপেক্ষা না করেই কাজটি শুরু করে দেয়। এতে পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগেই মারা পড়ে খাদক পোকাদের দলও। এখন যদি উপকারী পোকাদের আগেভাগেই বাগানে ছেড়ে দেওয়া থাকে তবে অপকারী পোকাদের মাধ্যমে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।
বাগানে বাগানে এমন ইকোলোজিকাল হেভেন তৈরির জন্য টিআরএ জোর দিচ্ছে ফাঁকা জমিতে গাঁদা, গ্ল্যাডিউলাস, রজনীগন্ধার মতো ফুল চাষের ওপর। এর কারণ উপকারী পোকাদের সেখানে ছেড়ে রাখা গেলে সেগুলি খাবার পেয়ে পুষ্ট হতে থাকবে। ফলে লুপারদের আক্রমন শুরু হতেই তাঁদের পালটা হামলার কাজ শুরু হয়ে যাবে। পাশাপাশি চা শিল্প অর্থকরী ওই ফুল বিক্রির মাধ্যমে বিকল্প আয়ের অন্য দিশাও খুঁজে পাবে। বিষয়টি অনেকটা একসঙ্গে রথ দেখা ও কলা বেচার মতো। পোকা দমনে পোকার পাশাপাশি পাখি, বাঁদুড়দের ওপরও আস্থা রাখতে চাইছেন চা বিজ্ঞানীরা। ইকোলোজিকাল হেভেন প্রকল্পে এজন্য বিহঙ্গ কূল যাতে বাগানে ডেরা বাঁধে সেজন্য আলাদা করে ‘বার্ড বক্স’ রেখে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। জোর দেওযা হচ্ছে বাঁদুড়দের জন্য ‘ব্যাট বক্স’ রাখার ওপরও। নানা ধরনের পাখি ও বাঁদুড় দুই-ই রোগপোকা সাবাড় করে। বলা হচ্ছে, বাগানে জলাশয় তৈরির কথাও।
টিআরএ-র টোকলাই শাখার পতঙ্গ বিজ্ঞানী ডঃ সোমনাথ রায় বলেন, ‘চা শিল্প সমেত মূলত ক্ষুদ্র চা চাষিরা এই পদ্ধতির মাধ্যমে দারুণভাবে উপকৃত হতে পারবে বলেই বিশ্বাস করি।‘ প্রকল্পটি সংস্থার নির্দেশক ও বিশিষ্ট পতঙ্গ বিজ্ঞানী ডঃ আজরাইয়া বাবুর নেতৃত্বে আরও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। টিআরএ-র কাজে দারুনভাবে উৎসাহিত উত্তরবঙ্গের চা শিল্প মহল। জলপাইগুড়ি জেলা ক্ষুদ্র চা চাষি সমিতির সম্পাদক বিজয় গোপাল চক্রবর্তী বলেন, ‘অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। এমন ন্যাচারাল ফার্মিং-এর ওপর এখন গোটা দুনিয়াই জোর দিচ্ছে। রাসায়নিকের ব্যবহার কমে গেলে উৎপাদন খরচও এক লপ্তে অনেকটাই হ্রাস পাবে।‘