Home Third Lead চুয়াডাঙ্গায় ফসলহারা কৃষকের আর্তনাদ

চুয়াডাঙ্গায় ফসলহারা কৃষকের আর্তনাদ

চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইয়াকুব হোসেন বলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরে ও প্রান্তিক পর্যায়ে ভুট্টা, তামাক ও পানের বরজে শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, চুয়াডাঙ্গার অর্থনীতিতে ব্যাপক আঘাত করেছে।
  • ১৬,৫০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত
  • ১০৮ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি
  • সংকট কাটাতে প্রয়োজন সুদমুক্ত কৃষিঋণ
মোঃ আব্দুল্লাহ হক, চুয়াডাঙ্গা থেকে: চোখে না দেখলে অনুমানও করা যাবে না কি সর্বনাশ হয়েছে এখানে ফসল ও বাড়ি-ঘরের। অধিকাংশ বাড়ির টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে। আর কিছুদিন গেলে যে ফসল সংগ্রহ করা হতো, তা মাটির সাথে মিশে আছে। তাতে কৃষকরা পথে বসে গেছেন। কিভাবে ঋণের অর্থ শোধ করবেন সেই চিন্তায় তারা দিশেহারা ।
সাম্প্রতিক শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে এমন ক্ষতির মুখে পড়েছেন চুয়াডাঙ্গার মানুষেরা। কৃষকরা ঋণ নিয়ে বিঘার পর বিঘা জমিতে  ভুট্টা, গম, তামাক, মসুর, কুল, তরমুজ, পানসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ করেছিলেন। কিন্তু শিলাবৃষ্টি আর ঝড়ে খেতের সব ভুট্টাগাছ ভেঙে মাটির সাথে লেপটে আছে। নতুন করে ভুট্টা চাষের কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া আমের মুকুলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।  দোকান থেকে বাকিতে কেনা সার কীটনাশকরে টাকা কিভাবে শোধ করবেন সেই চিন্তা প্রতিটি কৃষকের।
এভাবে মাটির সাথে মিশে গেছে মাঠের ভুট্টা ক্ষেত
চুয়াডাঙ্গার কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ছয় ইউনিয়ন, দামুড়হুদা উপজেলার আংশিক দুটি ইউনিয়ন এবং আলমডাঙ্গা উপজেলায় হাজার হাজার কৃষকের  সাড়ে ১৬ হাজার ৪৯৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১০৮ কোটি টাকার বেশি।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার পুরাতন বাসস্ট্যান্ড পাড়ার গ্রামের নতুন উদ্যোক্তা মোঃ শিমুল হাসান পলক বলেন, চাকরি ছেড়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ১০ বিঘা জমিতে কুল, মাল্টা, ড্রাগন ও পেয়ারা চাষ করেছিলাম। এই ঝড়- শিলা বৃষ্টিতে ১০০ মণের বেশি কুল পড়ে গেছে। গাছে যে কুলগুলো আছে, সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত । এ ছাড়া ২০০ মণ পেয়ারা শিলা পড়ে নষ্ট হয়েছে।
পাশাপাশি ড্রাগন ও মাল্টা গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কখনো পোষাবার নয়। এখন কোথায় থেকে এই ঋণের টাকা শোধ করব? সরকারের অনুদান পেলে হইতো আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।
সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলো হলো: সদর উপজেলার আলুকদিয়া, মোমিনপুর, শংকরচন্দ্র, কুতুবপুর, গড়াইটুপি ও পদ্মবিলা। দামুড়হুদা উপজেলার নতিপোতা ও জুড়ানপুর ইউনিয়নের আংশিক ও আলমডাঙ্গা উপজেলার কিছু স্থান।
সাতগাড়ী গ্রামের কৃষক হযরত আলী বলেন, ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে আমার চার বিঘা জমির ভুট্টা সব শেষ হয়ে গেছে। একটি গাছ ও ভালো নেই। সেগুলো রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার ছাড়া কোনো উপায় নেই। বরজের পানও সব নষ্ট হয়ে গেছে। ধারকর্জ করে ফসল ফলিয়েছিলাম। এখন পথে বসা ছাড়া উপায় দেখছি না।
পৌর এলাকার তালতলা ও হাজরাহাটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এই গ্রামে বেশিরভাগ পান চাষি। এই দুটি গ্রামে ৬০০ থেকে ৭০০ পান বরজই আছে। ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে সব পান বরজ নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় কৃষকরা হতাশায় পড়ে গেছেন। কারোর বাড়ির টিন ছিদ্র হয়েছে। কোনো রকম পলিথিন দিয়ে রেখেছেন তারা। একদিকে ফসলের ক্ষতি, অন্যদিকে বাড়ির টিন ফুটো।
হাজরাহাটি গ্রামের মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমি খুবই দরিদ্র। ৷ ধারদেনা করে পান বরজটা দাঁড় করেছিলাম। ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে সব শেষ হয়ে গেছে৷ আবার ঘরের টিন অনেকস্থানে ফুটো হয়ে গেছে৷ এখন কিভাবে ধারদিনে শোধ করবো?
সরকারের অনুদান পেলে আমরা চলতে পারব। এ ছাড়া এখন চলার কোনো উপায় নেই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
জেলায় ভুট্টার আবাদ হয়েছে ৪৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে।  শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ১৩ হাজার ২৫৩ হেক্টর জমির ফসল। গম ৯৯৫ হেক্টরের মধ্যে ক্ষতি হয়েছে ৫৫ হেক্টর, বোরো ধান ৩৬ হাজার ৮৭৯ হেক্টরের মধ্যে ১ হাজার ৪৭০, কলা ১ হাজার ৫২৬ হেক্টরের মধ্যে ১৫৩, পেঁপে ৫২০ হেক্টরের মধ্যে ৯৫, পেঁয়াজ ১ হাজার ৬১৫ হেক্টরের মধ্যে ৩৫, মসুর ৯১৭ হেক্টরের মধ্যে ২৩৪ ও রসুন ২৬৬ হেক্টরের মধ্যে ২০ হেক্টর জমির ফসলে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
তা ছাড়া পানবরজ ১ হাজার ৬২২ হেক্টরের মধ্যে ২৭৫ হেক্টর, তরমুজ ১১০ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৫, আম ২ হাজার ৪২৯ হেক্টর জমির মধ্যে ৪৩০, পেয়ারা ১ হাজার ৭৪১ হেক্টর জমির মধ্যে ১৮৫, লিচু ২৫৫ হেক্টর জমির মধ্যে ২০, তামাক ৩২৭ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৩, ধনেপাতা ১৯০ হেক্টর জমির মধ্যে ৪০ ও শাকসবজি ৮ হাজার ৩৪২ হেক্টর জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮০ হেক্টর জমি। এ ছাড়া কুল বা বরই, টমেটোসহ সব ধরনের সবজির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। সব থেকে ধান ক্ষতিগ্রস্ত কম হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসার তালহা জুবায়ের মাসরুর বলেন, ‘শিলাবৃষ্টির পর আমি ফসলের মাঠ পরিদর্শন করেছি।সদর উপজেলায় ছয় ইউনিয়নের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সব থেকে ভুট্টা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া তরমুজ, কুল, আমের মুকুলে ক্ষতি হয়েছে। তবে ধানের ক্ষতি তুলনামূলক কম। এমন ক্ষয়ক্ষতি আগে কখনো দেখেনি আমরা। অনুমান করছি সদরের ছয় ইউনিয়নে ১০০ কোটি টাকার বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. আব্দুল মাজেদ জানান মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে ফসলের এমন ক্ষতি আগে কখনো দেখেনি আমরা। দেশের মধ্যে ভুট্টা চাষের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে চুয়াডাঙ্গায়। তাই এখানে যে পরিমাণ ভুট্টার ক্ষতি হয়েছে, তা কখনো পোষাবার নয়।
চুয়াডাঙ্গার আবহাওয়া ও কৃষি অধিদপ্তর বলছে, চুয়াডাঙ্গার মানুষেরা এর আগে এমন শিলাবৃষ্টি দেখেনি। কৃষকদের ফসলের এমন ক্ষয়ক্ষতি আগে কখনো হয়নি। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ১০৮ কোটি টাকার বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ উদ্যোক্তা ফোরাম চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি মোঃ তাহমিদ হাসান তমাল বলেন চুয়াডাঙ্গায় স্মরণকালের শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ ক্ষতি চুয়াডাঙ্গার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষকদের কাটিয়ে ওঠা খুবই কঠিন, সরকার ও কৃষি বিভাগের সহায়তায় কৃষকরা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এই মূহূর্তে প্রয়োজন সুদমুক্ত কৃষিঋণ।
চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইয়াকুব হোসেন বলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরে ও প্রান্তিক পর্যায়ে ভুট্টা, তামাক ও পানের বরজে শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, চুয়াডাঙ্গার অর্থনীতিতে ব্যাপক আঘাত করেছে।