আবদুল জলিল
খাগড়াছড়ি: পাহাড়ে এখন জুম চাষের প্রস্ততি চলছে। সবুজ পাহাড় আগুন পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। চাষ উপযাগী করতে এমন পদ্ধতি যুগের পর যুগ ব্যবহার করে আসছে জুমিয়ারা। খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলায় এভাবেই চলছে জুম চাষের প্রস্তুতি। পাহাড় দেয়া আগুনে পুড়ে মরছে বন্যপ্রাণী ও ধংস হচ্ছে আবাসস্থল। সনাতন পদ্ধতিতে পাহাড়ে চাষাবাদ করায় কমছে উৎপাদন । পাহাড়ি ভূমি হারাচ্ছে উর্বরতা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম একটি আদিম বা সনাতন চাষ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে এক পাহাড় থেক অন্য পাহাড়ে জুম চাষ করা হয়। প্রতিবছর খাগড়াছড়ি ,রাঙামাটি ও বান্দরবানে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে জুমের আবাদ হয়। জুম ধানসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির ফসলের আবাদ হয়। জুমিয়াদের মতে, বারবার একই পাহাড়ে জুম চাষের ফলে জুম ভূমির উর্বরতা কমছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন প্রায় ১৩ হাজার ১শ ৮৪ বর্গকিলামিটার। যা দেশের মোট আয়তনের ১০ ভাগের ১ ভাগ। এখানকার ৬০ শতাংশ ভূমির গঠন পাহাড় ও উপত্যকা কেন্দ্রিক। ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত খাদ্যের যোগান দিতে জুমের ভূমির ব্যবহার বাড়ছে।
খাগড়াছড়ির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেশীরভাগ মানুষ জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। অতীতে এক পাহাড়ে জুম চাষ করার পর ১০ থেকে ১৫ বছর পর আবার সেই পাহাড়ে জুমের আবাদ করা হতো । তবে বিরতিহীনভাবে জুমে চাষাবাদ হওয়ায় কমছে জুম ভূমির উর্বরতা। বছরের পর বছর জুমচাষ করলেও সরকারিভাবে কোন ধরনের কৃষি প্রনোদনা পায় না জুমচাষীরা। সরকারিভাবে প্রনোদনা চায় জুমিয়ারা । জুমের ফলন বাড়াতে আধুনিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করার পরার্মশ দিচ্ছে কৃষি গবেষকরা ।
সর্বশেষ আদমশুমারী অনুযায়ী , খাগড়াছড়িতে চাকমা,মারমা ও ত্রিপুরাসহ প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বসবাস। এদের বেশীর ভাগই পাহাড়ের সনাতনী জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ২শ বছরের বেশী সময় ধরে এরা বংশ পরম্পরায় এই পেশায় জড়িত। জুম ধান, হলুদ,মারফা, মিষ্টি কুমড়া, তিল, ভুট্টা, বরবটিসহ প্রায় ৪০ ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়। জুমিয়ারা জানান, অতীতে এক পাহাড়ে জুম চাষ করার পর ১০ থেকে ১৫ বছর পর সেই পাহাড়ে জুমের আবাদ করা হতো । তবে পাহাড়ে রাবার বাগান,সেগুনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক বনায়নের ফলে কমছে জুমের পরিমান। বাধ্য হয়ে মাত্র ২ থেকে ৩ বছর পর একই পাহাড়ে জুমের আবাদ করা হচ্ছে।এতে কমছে জমির উর্বরতা ।
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকতা ড.মুন্সী রাশীদ আহম্মদ বলেন,‘ মাটির ক্ষয়, নিম্ম উর্বরতা, ফসলের অনুন্নত জাত ব্যবহার ও আধুনিক চাষ পদ্ধতি ব্যবহার না করার কারণে জুমে উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
এক জরিপে দেখা যায়,‘ পাহাড়ি জুমের জমিতে ১৯৫০ সালে মাটির উপরের স্তরের কার্বন বায়োমাসের পরিমাণ ছিল ৮৫ শতাংশ,১৯৯০ সালে তা হয় ৭৪ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে এর পরিমাণ ৪০ শতাংশ এসে দাঁড়াবে। প্রতি বছর পাহাড় থেকে হেক্টরে ৮০ থেকে ৯০ টন মাটির ক্ষয় হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে। সনাতনী জুম চাষের কারণে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস,মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি ও মাটির পুষ্টি উৎপাদনকে তরান্নিত করছে। ড.মুন্সী রাশীদ আহম্মদ বলন,‘ জুম উৎপাদন বাড়াতে হলে উন্নত জাত ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
খাগড়াছড়ির সীমানাপাড়ার নবীন ত্রিপুরা জানান, গত মৌসুমে (২০২০ সাল) জুমে ভুট্টা,ধান,মারফা ও পানের চাষ করছি। যা উৎপাদন হয়েছে তা দিয়ে সংসার চলে না। এবছর একই জমিতে জুমের আবাদ করার প্রস্তুতি নিয়েছি। জুম চাষ করে যা আয় করেছি তা শেষ হয়ে গেছে। আমরা বাধ্য হয়ে একই পাহাড়ে এবছর আবার চাষাবাদ করছি ।
একই এলাকার কৃষক হতেন ত্রিপুরা বলেন, এখানে কেউ সরকারিভাবে সার-বীজ,কীটনাশকসহ কোন সুবিধা পায়না। ফলে সনাতনীভাবে জুম চাষ করার কারণে উৎপাদনও বাড়ছে না। সরকার জুমচাষীদের কৃষি ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা দিলে জুমচাষীরা ঠিক থাকতে পারবে। আমরা জুম চাষ না করলে খাবো কি?
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মত্তুর্জ আলী বলেন ,‘ পার্বত্য এলাকায় অধিকাংশ কৃষক জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সনাতনী পদ্ধতিতে জুম চাষের কারণে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে জুমের উৎপাদন বাড়বে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জুমচাষীদের আধুনিক উৎপাদন ও পদ্ধতির কলাকৌশলী সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি।