খোন্দকার মহিতুল ইসলাম রঞ্জু:
“তুই থুলি না মুই থুলো, তুই থুলি তুই থুলি তুই থুলি” — জোড়া পাখির বুলি। গ্রামের লোক বলে ‘তুই থুলি’ পাখি। আবার অনেকে বলে, এটা ধুতুম পাখি। আমি গ্রামে গেলে এই পাখির ডাক উপভোগ করি।
দূর থেকে বাতাসে আরো অনেক পাখির কূজনের ভিতর এই ডাক ভেসে আসে। এবার গ্রামে যেয়ে এই পাখির ডাক শোনা গেল না। গ্রামের মানুষের কাছে জানতে চাইলাম, ‘তুই থুলি’ পাখির ডাক শুনি না কেন? ছেলে -বুড়ো নির্বিশেষে বললো: এই পাখি হারিয়ে গেছে। এখন বিলুপ্তপ্রায়।
ছোট বেলায় বাবার মুখে শোনা গল্প। সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। কোনো এক গ্রামে বাস করতো হতদরিদ্র এক যুগল। তারা নিত্য লড়াই করে অভাবের সাথে। সংসার চলে না। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটায়। একসময় তাদের হাতে এলো এক থলে টাকা। পুরুষটা এই টাকা রাখতে দেয় বউর কাছে। সে যত্ন করে রাখে। কিছুদিন পর ছেলেটি তার বউকে বলে, টাকার থলেটা দাও। বউ ঘরে ঢুকে টাকার থলি খুঁজতে থাকে। কিন্তু এ কী ? থলি গেল কোথায়। বিলম্ব দেখে ছেলেটিও ঘরে ঢুকলো। থলে নাই শুনে সে দিশেহারা। নিজেও বউর পাশাপাশি টাকার থলি খুঁজতে লাগলো । পুরো ঘরে চিরুনি তল্লাশী। কিন্তু, না- কোথাও নাই থলি।
সংশয়বাদী বউ তখন তার বরের কাছে জানতে চায়, থলেটা আমিই রেখেছিলাম, নাকি তুমি আবার কোথাও রেখেছিলে। বর এ কথা শুনে ক্ষেপে যায়। বলে, তুমি রেখেছো। আমি নিজে তোমার হাতে দিলাম। বউ বলে-হ্যাঁ, তুমি দিয়েছ। তারপর ঘরে ঢুকে নিজে আবার কোথাও রাখো নি তো? জিনিস হারালে আমাদের যেমনটি হয়, তেমন আর কি। এভাবে দুজনের বিতর্ক, সংশয়, সন্দেহ চলতে থাকে। সে সাথে বাড়তে থাকে শোকের মাত্রা। ‘টাকার শোক’ বলে কথা।
দুজনের খাওয়া দাওয়া বন্ধ।
ঘরে বসে একই কথার পুনরাবৃত্তি। তুই থুলি, না মুই থুলো। মানে তুমি রাখলে, না আমি রাখলাম। ছেলেটা তথন প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়ে বলে ওঠে, তুই থুলি, তুই থুলি, তুই থুলি। মানে, তুমি রেখেছো, তুমি রেখেছো, তুমি রেখেছো।।
তারা বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিল। না খেয়ে খেয়ে ছোট থেকে ছোট হতে লাগলো। এভাবে শোকে জর্জরিত এই যুগল এক সময় মানুষ থেকে পাখি হয়ে যায়। ডানা মেলে ঘর থেকে উড়ে যায়। ডালে যেয়ে বসে। ডালে বসেও টাকার শোকে সে একই রব। সে থেকে এখন পর্যন্ত ওরা একে অন্যকে বলে চলেছে, তুই থুলি না মুই থুলো।
আমরা গ্রামে গেলে এই পাখির ডাক কান পেতে শুনি। খুব মজা পাই। কিন্তু, এবার এই পাখির ডাক শোনা গেল না। পাখিকে নিয়ে কী চমৎকার কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে গ্রাম গঞ্জে। কিন্তু এই পাখি কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?
গ্রামে এবার ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনিনি। অথচ সূর্য ডোবার পর আমাদের নিবিড়তম গ্রামের চারপাশ থেকে কানে বাজতো ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক। রাতে জোনাকি পোকার আলোও চোখে পড়েনি।
গ্রামে চড়ুই পাখি আছে। কিন্তু আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই আর দেখা যায় না। কমে গেছে। তবে শালিক পাখি চোখে পড়েছে অনেক।এখনও গ্রামের ছেলেমেয়েরা জোড়া শালিক দেখাকে শুভ মনে করে।
-সংকলিত