দার্জিলিং এর দুটো বিশেষত্ব হল টয় ট্রেন এবং চা। টয় ট্রেনের পোশাকি নাম দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে বা ডিএইচআর সেটি ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছিল শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং রুটে টয় ট্রেনের চলাচল। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ডিএইচআরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমানে এটি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দার্জিলিং স্টেশন পর্যন্ত চলে। দার্জিলিং ঘুরতে গেলে একটিবার টয় ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতা অবশ্যই নেওয়া দরকার।
দার্জিলিং টয় ট্রেনের ইতিহাস
১৮৭০ সালের মধ্যে দার্জিলিং বেশ জনপ্রিয় ভ্রমণস্থান হয়ে উঠেছিল। কলকাতা থেকে প্রচুর ব্রিটিশ দার্জিলিং ঘুরতে যেতেন। ট্রেন, স্টিমার, গরুর গাড়ি করে যেতে সময় লাগত প্রায় দুই সপ্তাহ এবং যাত্রাপথ ও অতটা মসৃণ ছিল না। ১৮৭৮ সালে শিলিগুড়ি থেকে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয় এবং রংটং হয়ে তিনধারিয়া পর্যন্ত লাইন বসিয়ে ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে ভাইসরয় লর্ড লিটনকে নিয়ে প্রথমবার পরীক্ষামূলক ভাবে টয় ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়। সে বছরই খুলে যায় শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং অবধি রেলপথ। অবশেষে ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই টয় ট্রেন দার্জিলিং পৌঁছয়। তার ঠিক পরের বছরই অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টয় ট্রেনে চড়ে দার্জিলিং যান। ১৯৯৯-এর ২ ডিসেম্বর ইউনেস্কো দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে বা টয় ট্রেনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দেয়। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের গর্ব এই টয় ট্রেন। সেই কারণে সাহিত্য বা সিনেমায় মাঝে মাঝে টয় ট্রেনকে দেখানো হয়। করোনা পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে সিনেমায় টয় ট্রেন ভাড়া করার জন্য অনলাইনে আবেদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দার্জিলিং টয় ট্রেনে কীভাবে যাবেন
চৌরাস্তা মল থেকে ১ কিলোমিটার দুরত্বে দার্জিলিং স্টেশন অবস্থিত। চৌরাস্তা থেকে পায়ে হেঁটে স্টেশন যেতে লাগে ১৫-২০ মিনিট। তাছাড়া দার্জিলিং ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি করেও স্টেশনে যেতে পারেন। ভাড়া গাড়ি প্রতি ৩০০ টাকা। এই স্টেশন থেকেই টয় ট্রেন জয় রাইড বা প্যাসেঞ্জার ট্রেন নেওয়া যায়। এনজেপি-দার্জিলিং প্যাসেঞ্জার টয় ট্রেনে দার্জিলিং যেতে চাইলে নিউ জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কার্সিয়াং, তিনধারিয়া স্টেশন থেকে টয় ট্রেন ধরতে হবে। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন টয় ট্রেন খুবই ছোট হওয়ায় কামরায় লাগেজ রাখবার কোনও জায়গা নেই। তাই খুব বেশি লাগেজ নিয়ে টয় ট্রেনে চড়বেন না। সাধারণত এনজেপি-দার্জিলিং প্যাসেঞ্জার টয় ট্রেনের শেষে একটি লাগেজ রাখার ভ্যান যুক্ত করা হয়। তবে সবসময় এই ভ্যান নাও থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রে প্রচুর লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠলে আপনার অসুবিধা হবে।
দার্জিলিং টয় ট্রেনে কী দেখবেন
টয় ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দার্জিলিং স্টেশন পর্যন্ত চলে। এই দূরত্বটি অতিক্রম করতে প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা সময় নেয়। টিকিটের দাম মাথাপিছু ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। শিলিগুড়ি বা কার্সিয়াং থেকেও ট্রেনে উঠে দার্জিলিং যেতে পারবেন। তবে হাতে এত সময় না থাকলে এবং শুধু টয় ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতা নিতে চাইলে সাড়ে সাত ঘণ্টা যাত্রার বদলে ২ ঘণ্টার টয় ট্রেন জয় রাইড নিতে পারেন। জয় রাইডের ক্ষেত্রে দার্জিলিং স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু হয়ে বাতাসিয়া লুপ এবং ঘুম স্টেশন হয়ে টয় ট্রেন আপনাকে আবার দার্জিলিং স্টেশনে নামিয়ে দেবে। সাধারণত দুই ধরনের টয় ট্রেন থাকে। বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের টয় ট্রেন এবং ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের টয় ট্রেন। বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের টয় ট্রেন জয় রাইডের মূল্য মাথাপিছু ১৫০০ টাকা এবং ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের টয় ট্রেন জয় রাইডের মূল্য মাথাপিছু ১০০০ টাকা। বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের টয় ট্রেনটি যাত্রীদের পুরনো দিনের অনুভব দেওয়ার জন্যই মূলত রাখা হয়েছে। এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এর মূল্য বেশি। অনলাইনে জয় রাইডের টিকিট কাটার সময় যাবার স্টেশন দার্জিলিং এর কোড DJ এবং গন্তব্য স্টেশন হিসেবে দার্জিলিং এর কোড DJRZ ব্যবহার করলে জয় রাইড বুক করতে পারবেন। দার্জিলিং স্টেশন থেকেও টয় ট্রেনের টিকিট বুক করা যায় কিন্তু আগে থেকে বুক করে না এলে দার্জিলিং ঘুরতে এসে জয় রাইড পাওয়া মুস্কিল হয়ে পড়ে। তবে একান্তই জয় রাইড না পেলে দার্জিলিং স্টেশন থেকে সকালের দার্জিলিং-কার্সিয়াং প্যাসেঞ্জার ট্রেনের টিকিট কাটতে পারেন। এই ট্রেনটিও বাতাসিয়া লুপ এবং ঘুম স্টেশন হয়ে কার্সিয়াং যায়। তবে টিকিট কাটার আগে ট্রেনটি ঘুম হয়ে যায় কিনা সেটা নিশ্চিত করে নেবেন। এই জনপ্রিয় রাইডগুলো ছাড়াও প্রাইভেট বুকিংও হয়। যেমন শিলিগুড়ি থেকে তিনধারিয়া রুটে জঙ্গল সাফারি হয় যেখানে টয় ট্রেন আপনাকে মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়। টয় ট্রেন সফরে মূলত যে জিনিসগুলো দেখতে পাবেন সেগুলো উল্লেখ করা হল –
ট্রেন থেকে বাইরের অসাধারণ দৃশ্য – টয় ট্রেনে চড়ার মূল উদ্দেশ্যই হল এই হেরিটেজ পরিবহণে যাত্রাকালে বাইরের সুন্দর দৃশ্য। প্রাইভেট বুকিং হোক বা এনজেপি থেকে দার্জিলিং এর লম্বা সফর বা জয় রাইড, টয় ট্রেনে চেপে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এক কথায় অসাধারণ। পাহাড়ি রেলপথ যে সাধারণ রেলপথ থেকে কতটা আলাদা সেটা টয় ট্রেনে না চড়লে বুঝতে পারবেন না। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবী সৌন্দর্য, আঁকা বাকা ছবির মত পথ, পাহাড়ি গ্রাম ও মানুষ দেখতে দেখতে মনে হবে যেন কোনও রূপকথার দেশে রয়েছেন। এই অভিজ্ঞতাকে আরও সুন্দর করার জন্য ২০২১ সাল থেকে বেশ কিছু টয় ট্রেনে ভিস্টাডোম কোচ যুক্ত করা হয়েছে। এই কোচগুলোয় বড় বড় জানলার পাশাপাশি ছাদটিও কাচনির্মিত, যার ফলে এই কোচে সফর করলে এক অসাধারণ প্যানোরেমিক ভিউ পাওয়া যায়।
বাতাসিয়া লুপ – টয়ট্রেনের জন্য তৈরি একটি সর্পিল রেলপথ হল বাতাসিয়া লুপ। এই সর্পিল রেলপথটি দুর্দান্ত ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটি উদাহরণ। এটি ১৯১৯ সালে চালু হয়েছিল। টয় ট্রেনের জয় রাইডে ১০ মিনিটের জন্য ট্রেন এখানে থামে। এখানের মনোরম পরিবেশ এবং বাগানটি খুব সুন্দর। বিভিন্ন ধরণের গাছের সমারোহ এখানে। এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা সৈন্য়, যারা দেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল, তাদের সম্মান জানিয়ে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এই স্মৃতিসৌধের পেছনে কাঞ্চনজঙ্ঘার যে তুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গ দেখা যায়, সে এক অপরূপ দৃশ্য। এখানে ছবি তোলবার জন্য পাহাড়ি কাপড় ভাড়া পাওয়া যায়। তাছাড়াও এখানে কিছু হকার শীতের বিভিন্ন পোশাক বিক্রি করে। তবে জয় রাইডে বাতাসিয়া লুপ গিয়ে ছবি তোলা বা জামাকাপড় কেনা যাই করুন না কেন, ১০ মিনিটের মধ্যেই করবেন।
ঘুম স্টেশনের মিউজিয়াম – ৭৪০৭ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভারতের সর্বোচ্চ স্টেশন ঘুম। টয় ট্রেনের জয় রাইডে ট্রেন এখানে কুড়ি মিনিট দাঁড়ায়। স্টেশনের পাশেই আছে মিউজিয়াম যেখানে ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত রেলগাড়ির যাবতীয় সরঞ্জাম, পুরনো আমলের টয় ট্রেনের দুষ্প্রাপ্য ছবি এবং সেই সময়ের টয় ট্রনের মডেল সাজানো রয়েছে। এগুলো দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায়। স্টেশনের বেশ কিছু খাবারের দোকান রয়েছে। টয় ট্রেনে জয় রাইডে ঘুম স্টেশন থেকে ফেরার সময় ট্রেন কোথাও থামে না। সেক্ষেত্রে ঘুম স্টেশন থেকে চা/কফি কিনে সেটা পান করতে করতে বাকি সফরটি উপভোগ করতে পারেন।
দার্জিলিং টয় ট্রেনে কখন যাবেন
সারা বছর ধরেই দার্জিলিং যাওয়া যায় এবং টয় ট্রেনে চাপা যায়। তবে বর্ষাকালে দার্জিলিং এড়িয়ে যাওয়া ভাল। তাছাড়া আবহাওয়া খারাপ থাকলে ট্রেন এমনিও বাতিল হয়ে যায়। নিচে এনজেপি-দার্জিলিং প্যাসেঞ্জার টয় ট্রেন এবং জয় রাইডের বিস্তারিত সময়সূচি দেওয়া হল। এই ট্রেনগুলো প্রতিদিন চলাচল করে। প্রাইভেট বুকিং এর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়সূচী নেই। আপনাকে আলাদাভাবে বুক করতে হবে।
সতর্কতা ও পরামর্শ
- দার্জিলিং সফর প্ল্যান করার সময়েই টয় ট্রেনের টিকিট কেটে রাখুন। দার্জিলিং পৌঁছে বেশিরভাগ সময়েই দিনের দিন টিকিট পাওয়া যায় না।
- অনলাইনে জয় রাইডের টিকিট কাটার সময় যাবার স্টেশন দার্জিলিং এর কোড DJ এবং গন্তব্য স্টেশন হিসেবে দার্জিলিং এর কোড DJRZ ব্যবহার করুন। দুটো স্টেশন এক হওয়ার জন্য রেলওয়ে থেকে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
- টয় ট্রেনে কোন টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে না। জয় রাইডের ক্ষেত্রে দুই ঘণ্টার সফরে কোনও অসুবিধা না হলেও নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দার্জিলিং অবধি লম্বা সফর করলে আপনি কার্শিয়াং বা তিনধারিয়া স্টেশনে টয়লেটের সুবিধা পাবেন।
- সাধারণত এনজেপি-দার্জিলিং প্যাসেঞ্জার টয় ট্রেনের শেষে একটি লাগেজ রাখার ভ্যান যুক্ত করা হয়। তবে সবসময় এই ভ্যান নাও থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রে প্রচুর লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠলে আপনার অসুবিধা হবে।
- জয় রাইডের ক্ষেত্রে বাতাসিয়া লুপ বা ঘুম স্টেশনে ট্রেন যথাক্রমে ১০ মিনিট এবং ২০ মিনিট দাঁড়ায়। ওই সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ঘুরে আবার সময়ের মধ্যে ট্রেনের কামরায় ফিরে আসুন।
- টয় ট্রেনে আবর্জনা ফেলবেন না।
- অনেকেই ছবি তোলবার জন্য ট্রেন থামলে ট্রেনের চালকের আসনে উঠে যান। এরম কাজ থেকে বিরত থাকুন।
ট্রিপ টিপস
- টয় ট্রেনে জয় রাইড সফর করার প্ল্যান থাকলে অন্যদিন আলাদা করে টিকিট কেটে বাতাসিয়া লুপ বা ঘুম মিউজিয়াম দেখবার দরকার নেই। টয় ট্রেনের জয় রাইড টিকিটে এই দুটো জায়গা দেখবার বন্দোবস্ত থাকে।
- টয় ট্রেনে জয় রাইডে ঘুম স্টেশন থেকে ফেরার সময় ট্রেন কোথাও থামে না। সেক্ষেত্রে ঘুম স্টেশন থেকে চা/কফি কিনে সেটা পান করতে করতে বাকি সফরটি উপভোগ করতে পারেন।
- -সংগৃহীত