সদ্য প্রয়াত হয়েছেন বলিউডের অদ্বিতীয় মেগাস্টার দিলীপ কুমার। দিলীপ কুমারকে ছাড়া এবার নিজের জন্মদিন কাটাচ্ছেন সায়রা বানু। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও সেবা কোন স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে তাঁর প্রকৃত উদাহরণ বলিউড ডিভা সায়রা বানু। নিঃসন্তান সায়রা বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তাঁর সন্তান না হবার কারণে। তবু সায়রা নিজের ভালোবাসার প্রতি থেকেছেন অবিচল।মুসৌরিতে সায়রার জন্ম ১৯৪৪ সালের ২৩ অগস্ট। সায়রার মা ছিলেন তিন ও চার দশকের বিখ্যাত নায়িকা নাসিম বানু। যার রূপে মুগ্ধ হয়ে লেজেন্ডারি সুরকার নওশাদ বলেছিলেন ‘কী সুন্দর পরির মতো মুখখানি তোমার।’ সায়রার বাবা প্রযোজক এহসান উল হক। বাবার পরিবার খুবই অভিজাত বনেদি।
কিন্তু মায়ের দিক থেকে পারিবারিক অবস্থান বিশেষ সম্মাননীয় ছিল না। সায়রা বানুর দিদিমা ছিলেন চামিয়াঁ বাঈ। বিভিন্ন রাজা-রাজরার দরবারে নৃত্যগীত পরিবেশন করতেন তিনি। সায়রা ও তাঁর ভাই সুলতান যখন ছোটো‚ তখনই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁদের বাবা মায়ের। নাসিম বানু একাধারে সফল সিঙ্গল মাদার এবং সফল দাপুটে অভিনেত্রী ছিলেন সে যুগের।
দুই ছেলেমেয়েকে পড়াশুনোর জন্য তিনি পাঠিয়ে দেন ইংল্যান্ডে। সেই আর্থিক জোর ছিল নাসিম বানুর। যা তখনকার দিনে কম কথা নয়। লন্ডনে দীর্ঘদিন ছিলেন সায়রা ও তাঁর ভাই। তারপর সায়রা ফিরে আসেন মায়ের কাছে। ততদিনে নাসিম বানু ছবি করাও কমিয়ে দিয়েছেন।১৬ বছর বয়সে প্রথম নায়িকারূপে আত্মপ্রকাশ সায়রা বানুর, শাম্মি কাপুরের বিপরীতে ‘জংলি’ ছবিতে। এরপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন দিলীপ কুমার স্টার। দিলীপ কুমার সায়রাকে বাচ্চা বলেই গণ্য করতেন। কারণ দুজনের বয়সের তফাত ২২ বছর।বলিউডি খান পরম্পরার প্রথম ‘খান’ দিলীপকুমার। অভিনেত্রী দেবিকারানির সৌজন্যে ফিল্মে সুযোগ। ১৯৪৪ সালে মুক্তি পেল অমিয় চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘জোয়ার ভাঁটা’। দেবিকারানির পরামর্শেই নাম পাল্টে ফেলে ইউসুফ খান হলেন দিলীপ কুমার। এরপর তো ইতিহাস।দিলীপ কুমারের মন বারবার মজেছে নানা নারীতে। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় ‘শহিদ’। ছবিতে দিলীপকুমারের নায়িকা ছিলেন কামিনী কৌশল। তখন তাঁদের প্রেম ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে বহুচর্চিত বিষয়। বিয়ে করবেন তাঁরা ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু বাধা দিলেন কামিনীর দাদা। তিনি পছন্দ করতেন না দিলীপ কুমারকে, দিলীপকে নাকি হুমকিও দিয়েছিলেন। কামিনী বিয়ে করলেন প্রয়াত দিদির বরকে। দুর্ঘটনায় নিহত দিদির দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেন কামিনী। কামিনী-পর্ব মিটে গেল দিলীপ কুমারের জীবন থেকে।
এরপর দিলীপ কুমারের সঙ্গে তুমুল প্রেম গড়ে ওঠে বলিউড সুন্দরী মধুবালার। দীর্ঘ সাত বছরের প্রেম ভেঙে যায় মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খানের জন্য। রীতিমতো আদালতে কেস ঠুকে দিলীপ কুমার আর আতাউল্লাহ খানের ইগোর লড়াই চলে। শেষমেষ বাবার কথা শুনেই মধু সরে আসেন দিলীপের জীবন থেকে।
মধুবালা বিয়ে করলেন ডিভোর্সি কিশোর কুমারকে। কিশোরের প্রথমা স্ত্রী বাংলার রুমা গুহঠাকুরতা।
ইতিমধ্যে ‘জংলি’ ও ‘পড়োসন’-এর নায়িকা সায়রা বানু পছন্দ করতে শুরু করলেন আরেক হিরো রাজেন্দ্র কুমারকে। দুজনে একসঙ্গে নায়ক-নায়িকা হয়ে ছবিও করেছেন। কিন্তু রাজেন্দ্রকুমার ছিলেন বিবাহিত। তাই সায়রার মা নাসিম বানুর হস্তক্ষেপে সায়রা সরে আসেন রাজেন্দ্রকুমারের থেকে।
আবার নাসিম বানুই ঘটকালি করেন দিলীপ কুমার-সায়রা বানুর বিয়েতে। নাসিম বানু উদ্যোগী হন দিলীপ কুমারের সঙ্গে মেয়ের বিয়েতে। সায়রা বানুর মনে হয়েছিল, দিলীপকুমারকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তাঁর বহু দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হল। কারণ স্টার দিলীপকে ঘিরে প্রচ্ছন্ন ভালোলাগা সায়রার মনে ছিল নাবালিকা বয়স থেকেই। প্রথম আলাপে সায়রা বানুর রূপের প্রশংসা করেছিলেন দিলীপকুমার। কিন্তু ‘বাচ্চা মেয়ে’ বলে দূরত্ব বজায় রাখতেন।
১৯৬৬ সালে বিয়ে হয় দিলীপ কুমার ও সায়রা বানুর। সায়রা বানুকে বিয়ের সময় দিলীপকুমারের বয়স ছিল ৪৪ বছর। সায়রা বানু ছিলেন ঠিক অর্ধেক, মাত্র ২২ বছর।দিলীপ সায়রাকে বিয়ে করেছেন শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন দিলীপের প্রাক্তন প্রেমিকা মধুবালা। মধুবালার হার্টে সমস্যা তো ছিলই। কিন্তু তাঁর জীবনে আরও অবসাদ নেমে এসেছিল দিলীপ-সায়রার বিয়ের পর। তিন বছর পরে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন মধু। মধুবালা চেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছে নতিস্বীকার করুক দিলীপকুমার। তাহলেই বজায় থাকত তাঁদের সম্পর্ক। তা করেননি দিলীপ কুমার।
কিছুটা সময় তো দিলীপ কুমার আর বৈজয়ন্তীমালাও কাছাকাছি আসেন একসঙ্গে ছবি করার দৌলতে। যদিও স্থায়ী হয়নি সম্পর্ক।
এতজন প্রাক্তন থাকা এবং ২২ বছরের বড় দিলীপ কুমারকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে কোন অসুবিধে হয়নি সায়রা বানুর। সে সময় অনেকেই বলেছিলেন, এই বিয়ে বেশি দিন স্থায়ী হবে না। কিন্তু নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করে দিলীপকুমার-সায়রা বানু দুজনে দুজনের পাশে ছায়া হয়ে পাঁচ দশকের বেশি দাম্পত্যজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।যদিও সম্পর্ক যে ভাঙেনি তা নয়। ভেঙেছিল বেশ বড়সড়ভাবেই। সম্পর্ক টিকেছিল একমাত্র দিলীপকুমারের প্রতি সায়রার অগাধ প্রেম আর অগাধ ক্ষমার জন্যই। দিলীপ কুমার সায়রার প্রতি একটা সময় যা অবিচার করেছিলেন তা অন্য কোনও স্ত্রী হলে মেনে নিতেননা। আর যে স্ত্রী নামকরা নায়িকা এবং সাহসিনী পোশাকে তখন সায়রা সবার মাথা ঘুরিয়ে দিতেন।সায়রা-দিলীপের বৈবাহিক সম্পর্কে ভাঙন এনেছিল সায়রার মা হতে না পারা। সায়রার গর্ভে এসেছিল দিলীপ কুমারের সন্তান। তবে সন্তানধারনের পর সায়রা অসুস্থ হয়ে পড়েন। গর্ভপাত হয়ে যায় সায়রার। চিকিৎসক বাঁচাতে পারেননি দিলীপ-সায়রার সন্তানকে। চিকিৎসক আরও জানিয়ে দেন এ জিনিস বারবার ঘটবে, সায়রার মা হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেই আঘাত সহ্য করতে পারেননি দিলীপ কুমার। তাঁর মনে হয় এমন মেয়েকে বিয়ে করে তাঁর কী লাভ হল যে তাঁর বংশধরই দিতে পারবেনা। আর পাঁচটা সাধারণ স্বামীর মতোই দিলীপকুমারের মনে ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি।দিলীপ কুমার সায়রার পাশে থাকা দূর ঐ ঘটনার পরপরই দুজনের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
পাকিস্তানের নাগরিক আসমা রেহমানের আঁচলে বাঁধা পড়েন দিলীপকুমার। অন্ধ্রপ্রদেশে ক্রিকেট প্রদর্শনী ম্যাচে গিয়ে দিলীপকুমারের আলাপ তাঁর অনুরাগী আসমার সঙ্গে। আসমা তখন বিবাহিতা এবং তিন সন্তানের মা। আসমা ছিলেন দিলীপের বোনের বান্ধবী। কার মন কোথা মজে কে জানে! সন্তানের আশায় ঐ বিবাহিতা আসমার প্রেমেই পড়লেন ইউসুফ সাব। আসমা তখন ডিভোর্সী তাঁর বর সাদিকের থেকে।
এমন গুঞ্জনও শোনা যায়, তিনি সায়রা বানুকে তালাক দিয়ে বিয়ে করেছিলেন আসমাকে। বহুদিনই সায়রার থেকে আসমার প্রতি প্রেম ও দুর্বলতা লুকিয়ে রেখেছিলেন দিলীপকুমার। একটা সময়ের পর দিলীপকুমার আসমাকে নিজের পালি হিলের বাংলোতেও নিয়ে আসেন সহবাস করতে। যদিও সংবাদ মাধ্যমের কাছে তিনি সে গোপন গল্প অস্বীকার করেন। তবে দিলীপকুমার ফের বিয়ে করেছেন, এমন খবর কি আর চাপা থাকে? খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিষয়টি সায়রা বানুর কানে যায়। এমন খবরে নির্মম আঘাত পেয়েছিলেন সায়রা। তিনি আসমাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে বলেন।যদিও আসমা রেহমানের সঙ্গে দিলীপ কুমারের এই বিয়ে স্থায়ী হয়নি। আসমার ব্যবহারে বিরক্ত হন দিলীপ কুমার। দিলীপ কুমারকে কথায় কথায় অপমান করতেন আসমা। দু’বছরের মাথায় আসমাকে তালাক দেন দিলীপ কুমার এবং ফিরে আসেন সায়রার কাছে। আসমাও আবার বিয়ে করেন তাঁর প্রথম স্বামীকে এবং থাকেন সেই স্বামী-সন্তানের সঙ্গেই। দুজনেই দ্বিতীয় সম্পর্কে জড়িয়ে ভুল বুঝতে পেরে ফেরেন আবার সেই প্রথম সংসারে।যে কোনও মেয়ে এই অপমানের সম্পর্ক মেনে নেয়না। অথচ সায়রা সেদিন দিলীপ কুমারকে ফেরাননি। আশির দশক উত্তাল তখন দিলীপ কুমারের বহুগামী জীবন চর্চার খবরে। সেসবে কান না দিয়ে সায়রা বলেছিলেন “দিলীপসাব আমার জীবনের কোহিনূর”।
বিয়ের ১৬ বছর পর সায়রা বানু ও দিলীপ কুমারের কোনও সন্তান ছিল না। সন্তানলাভের আশায় পাকিস্তানের আসমাকে বিবাহ করেন দিলীপকুমার। অথচ সেই সায়রার কাছেই তাঁকে ফিরতে হল। দিলীপ কুমার বলেছিলেন আসমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল বিশাল ভুল। দুদণ্ড শান্তি পাবার আশায় তিনি ফেরেন সায়রার আশ্রয়ে।
এই যে দিলীপ ফিরলেন এইসময় থেকেই নিজের অভিনয় ক্যারিয়ার ছেড়ে দেন সায়রা। তাঁর যুক্তি ছিল বাইরে সময় দিয়ে আর কোনওভাবেই তিনি স্বামীকে হারাতে চাননা। নতুন করে তাঁদের বিয়ে হয় এবং তারপর থেকে অটুট ছিল তাঁদের দাম্পত্য। দিলীপ কুমার স্বীকার করেছিলেন সায়রার সাহচর্য ছাড়া তাঁর অভিনয়ের সেকেন্ড ইনিংস চলতনা।২২ বছরের বড় স্বামীর জরা পর্যায়ও একাই সামলেছেন সায়রা। নিজের সন্তান না থাকায় সন্তান-সাহায্য তিনি পাননি। বরং দিলীপকে সন্তান দিতে না পারার অক্ষমতাই যেন সেবা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলেন সায়রা। কিন্তু একজন নারী শুধুমাত্র মা হতে পারেননি বলে তাঁর সতীত্ব প্রমাণ করতে তাঁকে এত অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে? একজন টপক্লাস নায়িকা তিনি তবু কোনও পার্থক্য নেই আর পাঁচটা নারীর সঙ্গে তাঁর সহ্যশক্তির। যেখানে তাঁর স্বামীর পরস্ত্রীদের উপর দুর্বলতা কম ছিলনা। সায়রা সেসব ভাবেননি একশো ছুঁইছুঁই শতায়ু দিলীপ কুমারকে যেভাবে সেবা আর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন সায়রা তা উদাহরণ হয়ে থাকল। মানিয়ে নেবার ক্ষমতায় সায়রার সহ্যশক্তি স্যালুট করার মতো।সায়রার বান্ধবী হলেন আশা পারেখ, হেলেন, ওয়াহিদা রহমান, সাধনারা। সব বান্ধবীরা একসঙ্গে ট্রাভেল ট্যুরে গেলেও একমাত্র সায়রা যেতেননা। ৯৭ বছর বয়সী দিলীপ কুমারকে তাহলে কে দেখবে? নিজের দায়িত্ব থেকে এক চুল সরেননি সায়রা বানু।
‘ভালোবাসা থেকেই আমি দিলীপ সাহেবের দেখাশোনা করি। কারও প্রশংসা কুড়োতে এসব করি না। আমি চাই না কেউ আমাকে স্বামী-অন্তপ্রাণ স্ত্রী হিসেবে দেখুক বা বলুক। তাঁকে স্পর্শ করা, তাঁকে আদর-যত্ন করাটা আমার কাছে দুনিয়ার সেরা প্রাপ্তি। আমি তাঁকে ভালোবাসি, তিনি আমার প্রাণ’ বলেছিলেন সায়রা।
আসলে সায়রা বারবার দিলীপ কুমারকে ক্ষমা করেছেন। ভালোবাসা থেকেই এই ক্ষমা। নিজের কাছে নিজে শান্তি পেয়েছেন সায়রা। এখানেই তাঁর মহত্ব।
-ইন্টারনেট