সম্ভ্রান্ত পরিবার মানেই ছিল ‘গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান
বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
নতুনত্বের ছোঁয়ায় পুরনোকে একে একে বিসর্জন দিতে বসেছে আজকের প্রজন্ম৷
একসময় গ্রামীণ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হত ধানের গোলাকে, যা দেখে সেই সময় মেয়ের বিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল৷ সেসময় মেয়ের দিতে গেলে গ্রামাঞ্চলের মানুষজন আগে দেখতেন, বরপক্ষের ক’টি ধানের গোলা আছে৷ সেই ধানের গোলাই এখন বর্তমান প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতো আর বাড়ির প্রবীণ-প্রবীণাদের কাছে হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
খুলনার আড়ংঘাটার আবদুল ও মনুরা ‘গোয়াল ভরা গোরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান’ এর প্রসঙ্গ উঠতেই অতীতের স্মৃতিতে ডুব দেন৷ জানান, এসব দেখেই বড় হয়েছেন, অথচ সেসব আজ অতীত৷ তাঁরা জানান, বর্তমান প্রজন্ম চাষাবাদের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এখন ছোট পরিবার, উৎপাদিত ধান গোলায় রাখার কথা কেউ ভাবেই না। জমি থেকে ধান বাড়িতে তোলার সঙ্গে সঙ্গে তা আড়তদারের গুদামে পৌঁছে যায় বলেই তাঁরা জানান।
আগে যারা গ্রামের জমিদার ছিল তাদের গোলাভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ ছিল জমিদারি প্রথা ও উচ্চ চাষী পরিবারের ঐতিহ্য। পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া গোলাঘরে ধান চাল ওঠানো-নামানো হতো গরুর গাড়িতে করে। বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। আগামী প্রজন্মের কাছে গোলা ঘর একটি স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। আধুনিক গুদাম ঘর ধানচাল রাখার জায়গা দখল করছে। ফলে গোলা ঘরের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলে বিঘের পর বিঘে ধানের খেত দেখা গেলেও, গোলার দেখা নেই৷ ধান কেটেই তা বিক্রির উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন চাষিরা৷ কেউ তা আর মজুতই করেন না৷ তাই গোলার প্রয়োজনীয়তা কমেছে বর্তমান সময়ে৷ ফলে কালের সঙ্গে সঙ্গে ধানের গোলার ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে৷
গ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ, বাঁশের বাতা ও কঞ্চি দিয়ে প্রথমে গোল আকৃতির কাঠামো তৈরি করা হত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আয়তক্ষেত্র আকারেও গোলা তৈরি করা হত। এর পর তার গায়ে ভিতরে ও বাহিরে বেশ পুরু মাটির আস্থরণ লাগানো হত। এর মুখ বা প্রবেশ পথ রাখা হত বেশ উপরে যেন চোর/ডাকাতরা ধান চুরি করতে না পারে। গোলার মাথায় থাকত বাঁশ ও খড়ের তৈরি বা টিনের তৈরী ছাউনি। এসব ধানের গোলায় ১০০ থেকে ২০০ মণ ধান সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। খুলনার আড়ংঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামে এখনও চোখে পড়ে এসব ধানের গোলা।
এক সময় গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন আর গোলা নির্মাণ শ্রমিকদের দেখা মেলে না। পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। গোলা নির্মাণের জন্য তাদের সংবাদ দিয়ে আনতে হত। একেকটা গোলা নির্মাণ খরচ পড়ত তার আকার ও শ্রমিক কত লাগবে তার উপর নির্ভর করে।
মনু বলেন, ‘আগেকার দিনে একেকটা গোলা নির্মাণ করতে আমাদের খরচ পড়ত সেই সময়কার ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। তৈরীকৃত সেই সুদৃশ্য গোলা ছিল গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারের ঐতিহ্য। সে সময় ভাদ্র মাসে কাঁদা পানিতে ধান শুকাতে না পেরে কৃষকরা ভেজা আউশ ধান রেখে দিতো গোলা ভর্তি করে। গোলায় শুকানো ভেজা ধানের চাল হত শক্ত। কিন্তু ইদানিং মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তাই জমির পরিমানও কমছে , তাই গোলায় তোলার মত ধান আর তাদের থাকছে না , যার কারনে গোলার পরিবর্তে গ্রামের কৃষকরা ধান রাখা শুরু করে বাঁশের তৈরী ক্ষুদ্রাকৃতি ডোলায়।’
তিনি আরো বলেন, ধান আবাদের উপকরণ কিনতেই কৃষকের বিস্তর টাকা ফুরায়। কৃষকের ধানের গোলা ও ডোলা এখন শহরের বিত্তশালীদের গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। কৃষকের ধান চলে যাচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু মুনাফালোভী ফড়িয়া ও আড়ত ব্যবসায়ীর দখলে। ইট বালু সিমেন্ট দিয়ে পাকা ইমারত গুদাম ঘরে মজুদ করে রাখা হচ্ছে হাজার হাজার টন ধান চাল। অনেক ক্ষুদ্র কৃষক বস্তা ও ব্যারেল ভর্তি করে রাখছে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান চাল।