ড. আবদুল আলীম তালুকদার,
কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক
অনেক জাতিই এই বিশ্বে মহাসমারোহে তাদের নববর্ষ পালন করে এবং তা প্রায় চার হাজার বছর ধরে মানব সমাজে উদযাপিত হয়ে আসছে। নববর্ষ উদযাপন একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। মানব সভ্যতার সূচনালগ্নে মানুষ সূূর্য উদয়-অস্তের ভিত্তিতে রাত-দিন গণনা শুরু করেছিল। কিন্তু মাস গণনার শুরু করেছিল চাঁদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মানুষ চাঁদের বৃদ্ধি-হ্রাস দেখে মাস গণনা করত। এক শুক্লপক্ষ থেকে অন্য শুক্লপক্ষ কিংবা এক কৃষ্ণপক্ষ থেকে অন্য কৃষ্ণপক্ষ পর্যন্ত একমাস ধরে মাস গণনা তারা করত। এভাবে ১২ চান্দ্রমাসে এক বছর গণনা করা হতো। পরে সৌরবছর দিয়ে বর্ষ গণনা করা হয়। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি এক নয়। কেউ গণনা করে চন্দ্রের ভিত্তিতে, কেউ আবার সূর্যের ভিত্তিতে। আবার একদিন থেকেও সব বছর গণনা শুরু হয়নি। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। যেমন-ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজ’ পালিত হয় বসন্তের পূর্ণিমায়। অন্যদিকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ উদযাপিত হয় ১ জানুয়ারি। আবার বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয় গ্রীষ্মের শুরুতে অর্থাৎ ১ বৈশাখে। হিজরি নববর্ষ পালিত হয় মহররমের ১ তারিখে। সব জাতির বর্ষ গণনা যেমন এক নয়, তেমনি সব জাতির নববর্ষের উৎসবও এক নয়। প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উৎসবও পালিত হয় বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে। কৃষিনির্ভর বাঙালি জাতি নববর্ষ উদযাপন করে থাকে কৃষি সংস্কৃতির ভিত্তিতে।
নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ আমাদের স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত করে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এই দিনটি আমাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে স্বদেশী পণ্য, শিল্প, সাহিত্য, দেশজ সংগীত ইত্যাদির ওপর। স্বদেশ ও স্বজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দীপ্ত অনুপ্রেরণার দিন পহেলা বৈশাখ।
বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। জাতি-ধর্মণ্ডবর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সব বয়সের এবং সব শ্রেণি পেশার মানুষ এ দিনটি উদযাপন করে মহাধুমধামে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। এই উৎসবের প্রধান অনুসঙ্গ বৈশাখী মেলা। কৃষিজ পণ্য, কুটিরশিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য, প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা, নানা প্রকার মিষ্টান্ন ইত্যাদি বেচা-কেনার ধুম পড়ে যায় এই মেলায়। কোনো কোনো অঞ্চলে মেলায় আয়োজিত হয়ে থাকে ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, ঘোড়ার দৌড়, লাঠিখেলা, বলিখেলা, পুতুল-নাচ, নাগরদোলা, হা-ডু-ডু খেলা ইত্যাদি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান।
বাংলা সনের সূচনা থেকেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উদযাপন করে আসছে বাঙালি জাতি। অবশ্য আধুনিক যুগের বর্ষবরণ ও আগেকার দিনের বর্ষবরণের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বাহ্যিক-চাকচিক্য বাড়লেও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিদৃষ্ট হয়। বর্তমান ডিজিটাল যুগের নববর্ষ উদযাপনে পান্তা ভাত ও ইলিশসহ (যদিও এপ্রিল মাসজুড়ে মা ইলিশের ডিম দেওয়ার পূর্ববর্তী সময় এবং নদীতে ইলিশ শিকার আইনত নিষিদ্ধ) মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটলেও এতে ন্যাকামি বৈকি প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। এ উৎসব ধনি ও বিলাসি মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র, খেটে খাওয়া ও অসহায় মানুষের চিত্তে আনন্দ দিতে পারে না। আধুনিক যুগের উঁচুতলার মানুষের প্রাণহীন জমকালো কুরুচিপূর্ণ বর্ষবরণের কৃত্রিমতার তাণ্ডবে পিষ্ট হয় নিবিড় পল্লির বাঙালি দরিদ্র কৃষকদের প্রাণের উৎসব। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনাই হয়েছে বাঙালি কৃষকের সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে। বাংলা নববর্ষ উদ্ভাবনের মূলে রয়েছে কৃষক ও কৃষিজাত পণ্যসামগ্রী।
মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এদেশে বছর গণনা করা হতো। হিজরি বছর সৌরবছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এদেশের ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকরা ফসলি সন গণনায় সমস্যার সম্মুখীন হন। অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। এ জন্য কৃষক ও জমিদারের মধ্যকার সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। তাই দেখা যায়, বাংলা নববর্ষ সব বাঙালির হলেও উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশিই।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, মুসলিম ঐতিহ্যের হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে এবং বাংলা নববর্ষ প্রবর্তনের সঙ্গে দু’জন বিখ্যাত মুসলমান শাসকের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এদের একজন সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) এবং অপরজন মুঘল সম্রাট মহামতি জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবর (১৫৪২-১৬০৫ খ্রি.)। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তার নির্দেশেই বাংলা সনের প্রচলন হয়। বিশ্বখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালযের ডিগ্রিপ্রাপ্ত ভারতের উড়িষ্যার খ্যাতনামা ঐতিহাসিক কাশী প্রসাদ জয়সোয়াল (১৮৮১-১৯৩৭ খ্রি.) ছাড়াও অন্য দুই ক্ষেত্রের জগদ্বিখ্যাত দুই মনীষী সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন। তাদের একজন হলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা ও অন্যজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে ১৯৫২-৫৪ সালে ভারতীয় জাতীয় সন শকাব্দের সংস্কার করা হয়। সে উপলক্ষ্যে তিনি সম্রাট আকবরের ইলাহী সন এবং তা থেকে উদ্ভূত বাংলা সনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন : ‘In 1079 Ad. Sultan Jelaluddin Melik shak of Iran introduced a solar calender for Iran and this was introduced by emperor Akbar in Indian in 1584 ad. under the name Tarikh-i-ilahi. Akbars calender was used to date all events from his accession (1556 ad.) and was official calender during the reign of Jahangir and early part of Shahjahan’s reign when it fall into disuse. But it gave rise to a number of hybrid ears like the Bengali San and the Fasli Era which are still in use.’
অন্যপক্ষে অর্থশাস্ত্রে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ১৯৯৮ সালের ২০ আগস্ট ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে দেওয়া তার ‘An Assessment of the Millennium’ শীর্ষক ইউনেস্কো বক্তৃতায় সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের ব্যাপারটিকে যেভাবে দেখেছেন তাতে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসাবে মহামতি আকবরের দাবি আরও জোরালো হয়েছে। ড. সেন বলেন- A little over four hundred years ago, in 1591-92, as the year 1000 in the Hejira calendar approached. Emperor was on the mughal throne. The excitement which was widely felt in Delhi and Agra about the completion of the millennium in that reckoning led Akbar to issue a serious of proclamations about principle of governance.
অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই মত সমর্থন করেন যে, সম্রাট আকবরের রাজ-দরবারের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহ্ উল্লাহ্ সিরাজী সৌর ও চন্দ্র সনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির বাংলা সনের উদ্ভাবন করেন। রাজকার্যের সুবিধার্থে মুঘল সম্রাট আকবর হিজরি ৯৬৩ সালের অনুসৃত ও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন আজ তা একান্তই বাঙালির। মুঘল সম্রাট এ বাংলা সনের প্রবর্তন করেছিলেন খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য। এ সময়টি ছিল ফসল তোলার মৌসুম। তাই একে ফসলি সন বা কৃষি বর্ষও বলা হতো। মুঘল সম্রাটের খাজনা আদায়ের স্বার্থে বাঙালিরাও পেয়ে গেল নিজস্ব বর্ষ, নিজস্ব পঞ্জিকা। জন্ম থেকেই বাংলা সনে খ্রিস্টীয় সন থেকে ৫৯৩ যোগ করা হলে খ্রিস্টীয় সন অথবা খ্রিস্টীয় সন থেকে ৫৯৩ বিয়োগ করলে বাংলা সনের হিসাব পাওয়া যায়।
বর্তমান বাংলা সন ও ভারতীয় জাতীয় সন শকাব্দের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। বাংলা সনের মাস ও দিনের নাম শকাব্দের মাস ও দিনের নামগুলো থেকে নেওয়া। শকাব্দের মাসের এবং দিনের নামগুলো নেওয়া হয়েছে নক্ষত্রপুঞ্জের নাম থেকে। বৈশাখ নামটি এসেছে বিশাখা নক্ষত্র থেকে।
পারস্যের (বর্তমান ইরান) নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান ‘নওরোজ’ এর আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনাও করেন সম্রাট আকবর। ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ‘মিনাবাজার’। আর এ মিনাবাজারের আদলে বাংলা নববর্ষ উৎসবে যোগ হয়েছে বৈশাখী মেলা।
বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখী মেলা মুসলমানদের প্রবর্তিত বাঙালি সংস্কৃতি এটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। তবে সুযোগ বুঝে কট্টর ইসলাম বিদ্বেষীরা অশালীন-বিজাতীয় অপসংস্কৃতিকে বাংলা নববর্ষ উৎসবে একাকার করে ফেলে। দেশজ সংস্কৃতির বাতাবরণে কৌশলে নানান এসব অপসংস্কৃতি যোগ হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। বাংলা নববর্ষের সূচনাপর্বে এসব বিজাতীয় অপসংস্কৃতির কোনো বালাই ছিল না। মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে বাংলা নববর্ষ চালু হলেও মুসলমানদের উদারতার কারণে তা সার্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ধর্মণ্ডবর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি নববর্ষ উদযাপন করত মহাসমারোহে। মুসলমানরা দোয়া-মোনাজাত-মাহফিলের মাধ্যমে এবং হিন্দুরা পূজা-অর্চনার মাধ্যমে আগামী বছরের কল্যাণ কামনা করে নববর্ষ উদযাপন করত। কিন্তু কালক্রমে মুসলিম ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলা সন ও বাংলা নববর্ষ উদযাপনে যোগ হয়েছে পাশ্চাত্য ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতি যা প্রকৃতপক্ষে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে করছে কলুষিত।
সংস্কৃতি জাতির প্রাণশক্তি। ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে জাতীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্ম ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও অভিন্ন মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনায় বাঙালি সংস্কৃতি সমন্বিত ও সমৃদ্ধ। তবে বিশ্বায়নের নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার আমাদের সংস্কৃতি। অপসংস্কৃতিকে প্রতিহত করতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উচ্চকিত করতে হবে মানবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঙালি সংস্কৃতি। দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে।
যদিও শকাব্দণ্ডবিক্রমাব্দকে আশ্রয় করে বাংলা সনের দেশজ উপাদানগুলো সমাজে প্রচীনকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল। ফসলি হিজরির (৯৬৩ খ্রি.) ওপর এসব উপাদানের সংযোগ সাধন করে বাংলা সনের সামাজিক রূপ দেওয়া হয়। এ কাজটি দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবর সম্পন্ন করেন, আর মুর্শিদাবাদের নবাবরা বৈশাখকে বছরের প্রথম মাসরূপে গণ্য করে ও পহেলা বৈশাখকে নববর্ষরূপে উদযাপন করে একে জাতীয় জীবনে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা দান করেন। এটি দেশীয় ও মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়-সমীভবনের ফল; সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ঐতিহাসিক দলিল।
পরিশেষে বলা যায় যে, সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ও যুগোপযোগী হিজরিভিত্তিক বাংলা সন নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির জন্য গৌরবের। আর বাঙালি জাতি হিসেবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে চির জাগরুক থাকুক এই প্রত্যাশা নিরন্তর।