দেশের প্রথম মহিলা সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বখ্যাত নুরজাহান বেগম । বলা যায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় নারী সাংবাদিকতার প্রচলন করেছিলেন তিনিই। ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। ২০১১ সালে সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মানিত করে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিগত ৬৫ বছরের ইতিহাসে মহিলাদের জন্য প্রথম সচিত্র পত্রিকা ছিল ‘বেগম’। সেকালের মুসলিম মহিলাদের মধ্যে এই পত্রিকাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। পত্রিকার পাশাপাশি ‘বেগম ক্লাব’ও তৈরি করেছিলেন নুরজাহান বেগম।
১৯২৫ সালের ৪ জুন তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির চাঁদপুরের চালিতাতালি গ্রামে নুরজাহান বেগমের জন্ম হয়। তাঁর বাবা বিখ্যাত সাংবাদিক মহম্মদ নাসিরউদ্দিন ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৫২ সালে ‘কচিকাঁচার মেলা’র প্রতিষ্ঠাতা রোকুনুজ্জামান খানের সঙ্গে নুরজাহান বগমের বিবাহ হয়। ১৯৪২ সালে বেগম রোকেয়ার অনুরোধে কলকাতার শাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপরে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে পড়াশোনা করে তিনি বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘সওগাত’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় নুরজাহান বেগমের লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে মহম্মদ নাসিরউদ্দিনের সম্পাদনায় প্রথম মহিলাদের জন্য সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেব ‘বেগম’ প্রকাশিত হয়। পরে দেশভাগের কারণে ১৯৫০ সালে পত্রিকা দপ্তরটিকে সরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। বহু মুসলিম লেখিকাদের আত্মপ্রকাশের পথ খুলে দিয়েছিল এই ‘বেগম’ পত্রিকা।
বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। তাঁর পরে এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নুরহাজান বেগম। সেই সময় প্রাথমিক পর্বে ‘বেগম’ পত্রিকার ৫০০ কপি ছাপা হত এবং প্রতি কপির দাম নির্ধারিত ছিল চার আনা। একেবারে প্রথম সংখ্যাটির প্রচ্ছদেই ছাপা হয়েছিল বেগম রোকেয়ার ছবি। পত্রিকা প্রকাশের শুরুতে প্রথম চার মাস নুরজাহান বেগম তৎকালীন সম্পাদক বেগম সুফিয়া কামালকে সহায়তা করতেন। লেখা সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং কোন সংখ্যার জন্য কোন লেখা থাকবে তা নির্ণয়ে সাহায্য করতেন তিনি।
কলকাতায় থাকার সময় কৈশোরকালেই ‘বেগম’ পত্রিকার সঙ্গে পরিচিত হন কামাল লোহানী। পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন সমাজে শিক্ষিত মুসলিম নারী লেখকদের একটি বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে এই ‘বেগম’ পত্রিকা। পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলিতে এই পত্রিকার স্থায়ী অফিস গড়ে ওঠে। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ‘বেগম’ পত্রিকাটি প্রায় ২৫ হাজার কপি বিক্রি হত বলে জানা যায়। বছরে ৪৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হত বেগমের। কলকাতা থেকে ‘বেগম’ পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ পর্যন্তই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে এই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা হিসেবে দুটি ঈদ সংখ্যা এবং একটি বিশ্বনবী বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
১৯৫১-৫২ সাল থেকে ঢাকায় ‘বেগম’ পত্রিকার দপ্তর চলে আসায় এখান থেকেই এর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হত। ঈদসংখ্যাগুলির প্রচ্ছদে লেখিকাদের নাম ও ছবি থাকত যাতে লেখিকারা পরস্পরকে চিনতে পারেন। দেশের নানা প্রান্তে ডাকমাধ্যমে এই পত্রিকা পৌঁছাতে কোনও অসুবিধে হত না। শুধু মহিলা পাঠকরাই যে এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা নয়, বহু মুসলিম পুরুষও নিয়মিত এই পত্রিকা পড়তেন। ১৯৪৭ সালে মুসলিম সমাজের নারীদের প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যেত না। দেশের জাতীয় পরিসরে তাঁদের খুব বেশি স্বর শোনা যেত না। এমনকি সেই সময় মুসলিম মহিলারা নিজেদের ছবিও তুলতে পারতেন না। এই পরিসরেই নুরজাহান বেগম এক আমূল পরিবর্তন ঘটান। নুরজাহানের বড় হয়ে ওঠার সময়ে বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল এবং কাজী নজরুল ইসলামের প্রভূত প্রভাব ছিল।
১৯৫৪ সালে নুরজাহান বেগমের বাবা মহম্মদ নাসিরউদ্দিন তৈরি করেন ‘বেগম ক্লাব’। ‘বেগম’ পত্রিকার তরফে সমস্ত লেখিকাদের একত্রিত করতে এই ক্লাব তৈরি করা হয়েছিল। প্রথম দিকে মাসে একবার করে সমস্ত লেখক-লেখিকারা এই ক্লাবের আসরে একত্রিত হয়ে আলাপ-আলোচনায় অংশ নিতেন। পরে তা নিয়মিত প্রতি বছর একবার করে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। পাটুয়াটুলির অফিসেই বেগমের দপ্তরের পাশের ঘরে এই আসর বসত। পরবর্তীকালে নুরজাহান বেগম এই ক্লাবের পক্ষ থেকে লেখিকাদের সম্বর্ধনা দেওয়া শুরু করেন। বেগম ক্লাবের সম্পাদক ছিলেন নুরজাহান বেগম। এই ক্লাবের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম কবি সুফিয়া কামালকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবের কর্মকাণ্ড চলেছিল।
২০০২ সালে নুরজাহান বেগম প্রথম অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন এবং ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মানিত করে।
-সংগৃহীত