২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ-‘বিশ্ব পর্যটন দিবস’। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। এদেশে রয়েছে- বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত-কক্সবাজার, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চাল-সুন্দরবন, রয়েছে সমুদ্রকণ্যা-কুয়াকাটা, এবং অতীতকে স্বাক্ষী রেখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিকে আরোও সমৃদ্ধ করেছে ‘দুটি পাতা একটি কুড়ি’র নয়নাভিরাম চারণ ভূমি বাংলাদেশের চা বাগানগুলো।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। নদীমাতৃক এদেশে নদী ছাড়াও রয়েছে সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, বন, জল প্রপাত, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, আরোও আছে সবুজ শ্যামল চা বাগান। দেশের দক্ষিণ পূর্ব পাশে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। বৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন রয়েছে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম পার্শ্বে। এছাড়াও রয়েছে সমুদ্রকণ্যা কুয়াকাটা, যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। দক্ষিণে রয়েছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ময়নামতি, শালবন বিহার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে শহীদ মিনার, জতীয় স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, উত্তরে রয়েছে কান্তজির মন্দির ও মহাস্থানগর। এছাড়া উত্তর পূর্বে রয়েছে হজরত শাহজালাল (রঃ) মাজার, জাফলং, রাতারগুল, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, বিছানাকান্দি, লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) ও শ্রীমঙ্গলের সবুজ শ্যামল ঘেরা চা বাগান। আরোও রয়েছে বিভিন্ন নদ-নদী, ইকো পার্ক, ঝর্ণা, পাহাড়সহ নানা বৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যা আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছে।
পৃথিবীতে ‘টি টুরিজ্যম’একটি জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় সেক্টর। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশে চা উৎপাদিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত, শ্রীলংকা, চীন, ইন্দোনেশিয়াতে চা পর্যটন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চা বাগানের ভিতরে চিরসবুজের বুকে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়ানো, চা বাগানের বাংলোতে বসে সময় কাটানো, শ্রমিকদের সাথে তাল মিলিয়ে চা পাতা চয়ন, চা শ্রমিকদের বৈচিত্র্যময় জীবন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মাঝে হারিয়ে যাওয়া- এসব বিষয় পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। এছাড়াও কারখানায় কীভাবে চা প্রক্রিয়াজাত করা হয় তাও দেখার সুযোগ তৈরি হয়। হয়তো এরই মধ্যে হাতে আসে এক কাপ ধুমায়িত সতেজ চা।
ভারতের দার্জিলিং এর চা- বাগানগুলোতে বৃটিশ আমলের তৈরিকৃত বাংলোগুলোতে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে। অন্যদিকে, চায়ের উৎপত্তি স্থল চীনের চা বাগানগুলোতে প্রচুর পর্যটকদের আগমনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন হোটেল-মোটেল ও মিউজিয়াম। শ্রীলংকা ও ইন্দোনেশিয়াতেও চা বাগানকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। একইভাবে, বাংলাদেশেও চা বাগানকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলে বিভিন্ন আকারের ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেও গড়ে উঠছে সমতল ভূমির ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের পাহাড়েও চা চাষ শুরু হয়েছে। তবে দেশের সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়। জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলাকে বলা হয় চায়ের রাজধানী। চা বাগানের নয়নাভিরাম দৃশ্য যেন সবুজ গালিচা। সেখানে চা বাগানকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। মৌলভীবাজার শহরে ও চা বাগানের পাদদেশে রয়েছে বেসরকারী পর্যায়ে ৬০/৭০টি হোটেল ও রিসোর্ট।
পর্যটকদের চাহিদার ভিত্তিতে জেলায় যেমন আন্তর্জাতিক মানের পাঁচ তারকা হোটেল গড়ে উঠেছে তেমনি রয়েছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ছোট-বড় হোটেল ও রিসোর্ট যার মধ্যে-গ্রান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গল্ফ, লেমন গার্ডেন রিসোর্ট, দুসাই রিসোর্ট এন্ড স্পা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছে।
উল্লেখ্য, সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ চা বোর্ড বাণিজ্যিকভাবে টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়াম পরিচালনা করছে। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক ২০০৬ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়াম পরিচালনা করা হচ্ছে। উক্ত টি রিসোর্টটি চারিদিকে চা বাগানদ্বারা পরিবেষ্টিত। রিসোর্টটিতে বিভিন্ন পাহাড়ি টিলায় আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ ১৫টি পৃথক বাংলো, ক্যফেটেরিয়া, কীডস প্লেয়িং কর্নার, লন টেনিস কোর্ট রয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিকমানের আরেকটি রিসোর্ট ভবন তৈরি করা হচ্ছে। রিসোর্টের সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ ডিসেম্বর ২০২০ এর মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে অনলাইনে (tearesort.gov.bd) রিসোর্ট বুকিং সুবিধা চালু করা হয়েছে। আরো উল্লেখ্য, টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামের এক কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ সংস্থা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) অবস্থিত। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এ চা গবেষণা কেন্দ্রে সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। এখানে আসলে দর্শনার্থীরা বাগানের মনোরম পরিবেশ উপভোগ থেকে শুরু করে চা পরীক্ষণ খামার, চা প্রক্রিয়াজাত পদ্ধতি ও চায়ের নানা বিষয় প্রত্যক্ষ করতে পারে। এছাড়া বিটিআরআই রেস্ট হাউসে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে।
চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বর্ণিত টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়ামে চা শিল্পের ইতিহাস সংক্রান্ত অনেক জিনিসপত্র রয়েছে। মিউজিয়ামটি যুগোপযোগী করে ‘বাংলাদেশ টি মিউজিয়াম’ নামকরণ করা এবং উক্ত মিউজিয়ামে ‘বঙ্গবন্ধু গ্যালারি’ নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, চা মিউজিয়াম-এর যাত্রা শুরু ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরে। চা-বাগানে ঘেরা এ চায়ের জাদুঘরে বাংলাদেশের চা-শিল্পের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস ফুটে উঠেছে নানা সংগ্রহে–স্মারকে। জাদুঘরের প্রথম কক্ষেই রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি, তাঁর ব্যবহৃত চেয়ার ও টেবিল, যা তিনি ৪ জুন ১৯৫৭ সাল থেকে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হিসেবে থাকাকালীন ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়া, জাদুঘরে রয়েছে চা-বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার কাঁটা কোদাল, রিং কোদাল, তির-ধনুক, চা-গাছ ছাঁটাই কাজে ব্যবহৃত কলম দা’সহ ব্রিটিশ আমলে শ্রমিকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন হাতিয়ার, আছে লোহার পাপোশ, চা-শ্রমিকদের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ রুপা ও তামার মুদ্রা, কাঠের ফসিল, ঘটি, টেবিল, ব্রিটিশ সাহেবদের গুনতির কাজে ব্যবহৃত হাড়ের ছড়ি, লাঠি; শ্রমিকদের পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত কষ্টি পাথরের প্লেট, ব্যবস্থাপক বাংলোয় ব্যবহৃত প্রাচীন বেতার যন্ত্র, দেয়ালঘড়ি, চা-বাগানে চারা লাগানোর কাজে ব্যবহৃত বিশেষ যন্ত্র। চা-শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত সে সব অনুষঙ্গ দেখতে দেখতে মনটা কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
চা বাগানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। শ্রীমঙ্গলে মনিপুরী জনগোষ্ঠীর নানা ধরনের হস্তশিল্প ও নৃত্য এবং মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়াদের জীবনযাপন পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। হোটেল রেস্তোরাঁতে ব্লাক টি ও গ্রিন টি’র পাশাপাশি থাকছে নানা ধরনের ফ্লেভার টি ও সাত রংয়ের চা। আর শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে এসে চা এবং সাতকরা (লেবু জাতীয় ফল) না কিনে তো ফেরাই যাবে না।
চা বাগান পরিবেষ্টিত শ্রীমঙ্গলের সাথে সারা দেশের সড়ক পথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে রেলপথেও এখানে আসা যায়। এছাড়া বিমান পথে সিলেট পৌছে সড়কপথে শ্রীমঙ্গলে আসা যায়। একটু অবসর পেলেই ভ্রমন পিপাসুরা চা বাগানের সৌন্দয্য উপভোগ করতে সুবিধাজনক পথে চলে আসতে পারবে।
চা পর্যটনের এই বিকাশমান সেক্টরকে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের নিকট আরো বেশি জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্টপোষকতার সুযোগ রয়েছে-যা পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাবে এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
-সংগৃহীত