সালেহ নোমান
চট্টগ্রাম: বৈশ্বিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার-আইডিএমসি’র হিসাবে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড় জলোচ্ছাস ও বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, তা পৃথিবীর ১৩৫টি দেশের মধ্যে ষষ্ঠতম। দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য জাতীয়ভাবে সরকারের স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টার-এসওডি’র আওতায় কিছু সহায়তা পাওয়ার কথা থাকলেও তা জুটছে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
মেঘনা মোহনার উড়ির চরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন, তার ৪৫ বছরের জীবনে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন চারবার। গেল বছরের নভেম্বরের এক বিকেলে দুই নিকটাত্মীয়কে নিয়ে ১৫ বছরের বসতবাড়ি স্থানান্তরের কাজ করার সময় বলেছিলেন, ভাঙতে থাকা বাড়ির অনেক সামগ্রীই তিনি নতুন স্থানে নিয়ে যেতে পারছেন না।
অনোয়ার বলেন, এখনো নতন বাড়ি প্রস্তুত হয়নি। পুরানো বাড়ির কিছু সামগ্রী পাশের একটি বাড়িতে রেখেছি। এই বাড়ির অনেক গাছ ছিলো তা নামমাত্র মূল্যে বিক্রী করে দিয়েছি।
”এক সময় এই উড়ির চরে জমি সস্তা ছিলো, এখন আর সেই অবস্থা নেই। অনেক ভূমিহীন মানুষ চরে বসত করার জন্য আসছে, জমির দামও অনেক বাড়ছে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, উড়ির চরে ভাঙ্গন একটি নিয়মিত ঘটনা হলেও ভাঙ্গনে ঘর-বাড়ি হারা মানুষদের জন্য কোথাও থেকে সাহায্য মিলছেনা।
দেশে প্রতিবছর কত লোক এভাবে আনোয়ারের মতো বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তার সঠিক হিসাব সরকারের কাছে না থাকলেও আইডিএমসির হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে স্থায়ী বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৮৮ হাজার। পাঁচ দশকের বসতি উড়ির চরের ৬০ হজার বাসিন্দার প্রায় সবাই সমুদ্র ও নদী ভাঙনের শিকার হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের একজন ফাতেমা বেগম জানিয়েছেন, তিনবার বসত ভিটা স্থানান্তরের সময় পাশে পাননি কাউকে।
ফাতেমা (৬৫) বলেন, সন্দ্বীপের কাটগড় থেকে ভাঙ্গনে ঘর-বাড়ি হারিয়ে নতুন এই দ্বীপবসতিতে এসে আশ্রয় নেয়ার সময় এখানে কিছুই ছিলো না। ঘাস লতা-পাতা খেয়ে জীবন ধারন করতে হয়েছে, সাহায্য করার মত কেউ ছিলো না।
চার দশক আগে জনমানবহীন উড়ির চরে বসতি স্থাপনের সময় তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেই সম্পর্কে ফাতেমা বেগম বলছিলেন, ”হাট-বাজার হাসপাতাল, স্কুল কলেজ কিছুই ছিলোনা। কিভাবে যে জীবন ধারন করেছি সেটা শুধু আল্লাহ জানেন।”
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি ৭ জনের মধ্যে একজনের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশংকার কথা বলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, এই সংখ্যা দাড়াতে পারে ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়নে। এই মানুষদের জীবন যে আনোয়ার কিংবা ফাতেমার মত হবে না, তার জন্য অনেক বেশি কাজ করার তাগিদ দেয়া হচ্ছে আর্ন্তজাতিক এবং স্থানীয় পর্যায় থেকে।
২০১৫ সালে জাপানের সেনদাই শহরে অনুষ্ঠিত তৃতীয় দুর্যোগের ঝুকি প্রশমন অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনে গৃহীত সেনদাই ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী এবং ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত ’কপ-২০১৫ এ স্বাক্ষরিত এগ্রিমেন্ট এর নির্দেশনায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য ভাঙ্গন প্রতিরোধ, জরুরী সহায়তা এবং টেকসই পূনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করছে।
রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট রামরুর প্রধান নির্বাহী ডক্টর তাসনিম সিদ্দিক বলছেন, এই নীতিমালার কার্যকারিতা নির্ভর করছে সরকার, দাতা সংস্থা এবং মাঠ পর্যায়ের সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের উপর।
তাসনিম সিদ্দিক বলেন, এতদিন বাস্তুচ্যূত মানুষদের অধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। এই নীতিমালার অধীনে অধিকারের বিষয়টি প্রধান্য পাবে। সারাদেশে একযোগে এই নীতিমালার অধীনে পরিচালিত হবে যা বস্তুচ্যূত মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য একটি সুনিদির্ষ্ট কর্মপন্থা হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রস্তাবিত নীতিমালা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, কতটুকু কার্যকর হবে তা এখন দেখতে হবে, উল্লেখ করেন তিনি।
সরকারের দুর্যেোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আতিকুল হক বলেছেন, দেশে গৃহহীন প্রায় নয় লাখ মানুষের আবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুরাও আছেন।
আতকিুল হক বলেন, প্রথমে ঘর দেয়া হবে, যাদের ঘর ও জমি কিছুই নেই তাদেরকে। এরপরে ঘর দেয়া হবে যাদের শুধু জমি আছে তাদেরকে। নদী ও সমুদ্রের ভাঙ্গনে যারা গৃহহীন হয়েছে তারাও এই তালিকার অন্তর্ভূক্ত।
উড়ির চরের মত বাংলাদেশে মোট ৫০টির মত ছোট বড় দ্বীপের মধ্যে ৬টি হচ্ছে দ্বীপ উপজেলা। এর প্রায় সবগুলোই ভাঙ্গন প্রবণ।
(দেশের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিয়ে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক ইজেএন-এর সহায়তায় সিনিয়র সাংবাদিক সালেহ নোমান তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৈরি করেন, এটি প্রথম পর্ব)