Home Second Lead পিঠাভোগ থেকে জোড়াসাঁকো : কুশারি থেকে ঠাকুর

পিঠাভোগ থেকে জোড়াসাঁকো : কুশারি থেকে ঠাকুর

॥ আমিরুল মোমেনীন ॥
গ্রামের নাম পিঠাভোগ, অজ-পাড়াগাঁ। এই সেদিনও যোগাযোগের মাধ্যম ছিল কেবল নৌযান। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে পা মাড়াতেন না। দশ বছর আগে এই দিনে অর্থাৎ ২৫শে বৈশাখ প্রথমবারের মত এখানে সরকারিভাবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ওই সময় গ্রামটি আলোচনার কেন্দ্রে আসে। কারণ এখানেই যে ছিল কবিগুরুর পূর্ব পুরুষের বাস।
খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম পিঠাভোগ, পাশে ভৈরব নদী। এককালে পিঠাভোগ ঘাটে স্টিমার ভিড়তো। এখন ছোটখাটো লঞ্চও চলতে পারে না। এখানেই বাস করতেন কবিগুরুর পূর্বপুরুষ। পিরালী ব্রাম্মণদের সংগে আত্মীয়তা করায় এই বংশের একজনকে সমাজচ্যুত হতে হয়। বাধ্য হয়ে তিনি গ্রাম ছেড়ে যান। পরবর্তীতে তাদের একজন সেখান থেকে জোড়াসাঁকোতে গিয়ে বসতি গড়েন। এই বংশেই জন্ম নেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
খুলনা জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ভৈরব নদীর পূব পাড়ে পিঠাভোগ গ্রাম। এলাকাটি এতই দুর্গম ছিল যে একাত্তর সালে হানাদার পাক বাহিনী অনেক চেষ্টায়ও এখানে ঢুকতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এটি ছিল মুক্তাঞ্চল। এলাকাটিকে কয়েক বছর আগে খুলনা-বাগেরহাট সড়কের সংগে যুক্ত করা হয়েছে। নদীর উপর তৈরী হয়েছে সেতু। এখন খুলনা-বাগেরহাট থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে কবির পূর্ব পুরুষের ভিটেয় যাওয়া যায়। গ্রামের কাছেই ঘাটভোগ বাজার। এ পর্যন্ত পীচের রাস্তা। এরপর ইট বিছানো সরু রাস্তা চলে গেছে পিঠাভোগ গ্রামের মধ্য দিয়ে।
কবির মামাবাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ি উভয়ই খুলনা জেলার ফুলতলা থানার দক্ষিনডিহি গ্রামে। বই-পুস্তক বা পত্রিকার সুবাদে ওই গ্রাম যতটা পরিচিতি পেয়েছে সেই তুলনায় পিঠাভোগ ছিল একেবারে লোকচক্ষুর অন্তরালে। নব্বুইয়ের দশকে এই গ্রাম সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন খুলনার সেদিনের জেলা প্রশাসক শিল্প ও সাহিত্যমনা রিয়াজুল হক। তার উদ্যোগে বিশ্বকবির পূর্ব পুরুষের বস্তুভিটা সনাক্ত এবং সেখানে রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা নির্মাণ করা হয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের পদবি ছিল কুশারি। এটিও তাদের আসল পদবি নয়। এক সময় তারা বর্ধমান জেলার কুশ গ্রামের পত্তন পেয়েছিলেন। এ কারণে তারা কুশারি গোত্রভুক্ত হন। এই কুশারিরা পাবর্তীতে খুলনা, ঢাকা ও বাকুড়ায় বসতি গড়েন। তাদের একটি শাখা খুলনার পিঠাভোগ গ্রামে পত্তন নেন। কুশারিরা এখনও এই গ্রামে বাস করেন।
পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আউলিয়া হযরত খানজাহান আলি খুলনা অঞ্চলে আসেন। এর দু’শ বছর আগে থেকেই কুশারিরা পিঠাভোগ গ্রামে বাস করে আসছেন। শ্রুতি আছে কুশ গ্রামের তারানাথ কুশারি পিঠাভোগ গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তিনিই পিঠাভোগ গ্রামের কুশারিদের আদি পিতা। তারানাথ কুশারির ছিল দুই পুত্র রামগোপাল ও রামনাথ। রামগোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারি দক্ষিণ ডিহির শুকদেব রায় চৌধুরীর কন্যাকে বিয়ে করেন। শুকদেব রায় চৌধুরীরা বনেদি ব্রাম্মণ ও জমিদার হওয়া সত্ত্বেও ঘটনাচক্রে পিরালী ব্রাম্মণে পরিণত হন। দক্ষিণডিহি গ্রামের জমিদার দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে শুকদেব ছিলেন চতুর্থ। শুকদেবের অপর তিন ভাই হচ্ছেন- কামদেব, জয়দেব ও রতিদেব। এসময় হযরত খানজাহান আলি তাঁর প্রধান সহচর পীর আলী তাহিরকে এই অঞ্চলের শাসক নিয়োগ করেন। দক্ষিণানাথের পুত্র কামদেব ও জয়দেব পীর তাহেরের দেওয়ান নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ কারণে তাদের অপর দুই ভাই রতিদেব ও শুকদেব সমাজচ্যুত ও পতিত ব্রাম্মণে পরিণত হন। এই অবস্থায় রতিদেব সন্নাস গ্রহণ করে দেশ ছাড়েন। অপরদিকে অবিবাহিত এক বোন ও এক কন্যা নিয়ে বিপাকে পড়েন শুকদেব। তিনি অনেক টাকার বিনিময়ে পিঠাভোগ গ্রামের জগন্নাথ কুশারির সংগে কন্যার বিয়ে দেন। পীরালী ব্রাম্মণ-কন্যাকে বিয়ে করায় সমাজচ্যুত হন জগন্নাথ কুশারি এবং বাধ্য হয়ে তিনি পিঠাভোগ গ্রাম ছেড়ে দক্ষিণডিহি গ্রামে চলে আসেন। এখানে শ্বশুরের দেওয়া জায়গায় তিনি বসতবাটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ কুশারির চার পুত্রের মধ্যে পুরুষোত্তম কুশারি কলকাতার কাছে জোড়াসাঁকো গ্রামে গিয়ে বসতি গড়েন। জোড়াসাঁকো গ্রামে তখন ছিল নি¤œ শ্রেণীর হিন্দুদের বসবাস। তারা একজন ব্রাম্মণকে পেয়ে খুশী হয় এবং জগন্নাথ কুশারিকে ঠাকুর বলে সম্বোধন করতে থাকে। সেই থেকে জগন্নাথের পরিবার ঠাকুর হিসেবে পরিচিতি পায়। জোড়াসাঁকোয় গিয়ে বসতি গড়লেও কুশারি পরিবারের সংগে পিঠাভোগ গ্রামের যোগাযোগ ছিল। প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুর পিঠাভোগ গ্রামের খোাঁজ-খবর রাখতেন। তবে রবি ঠাকুর কখনও পিঠাভোগ গ্রামে এসেছেন কি-না তা নিয়ে দ্বিমত আছে। একবার খুলনায় সাক্ষি দিতে এসে তিনি পিঠাভোগ গ্রামে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল কি-না তা জানা যায় না। সম্ভবত: তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়নি কারণ পিঠাভোগ তখন দুর্গম এলাকা।
চার বছর আগে এক দুপুওে বাগেরহাট শহর থেকে মটর সাইকেলে পিঠাভোগ গ্রামে যাই। প্রায় ৪০ মিনিটের রাস্তা। পথ প্রশস্ত ও মসৃন হওয়ায় দূরত্ব বোঝা যায়নি। বাগেরহাট থেকে সোজা রূপসা উপজেলার কাজদিয়া বাজারে গিয়ে উঠি। সেখান থেকে ডানে মিনিট দশেকের রাস্তা শেষে ঘাটভোগ বাজার। এখান থেকে ইট বিছানো রাস্তা। হাটা পথে দশ মিনিটেরও কম দূরত্ব। বাজার থেকে ডানদিকে আগালে ৩০ গজ দূরেই পিঠভোগ গ্রামের রাস্তা। প্রবেশমুখে সদ্য নির্মাণ করা একটি তোরণ। তোরণের উপরে লেখাÑ রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা। গাছ-গাছালিতে ভরা নিরব-নিঝুম গ্রাম, বসতিও কম। কবির বাড়িতে গিয়ে প্রচন্ড হতাশ হতে হয়। দুই কোনায় দুটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর একটিতে রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা, অপরটি রবীন্দ্র মঞ্চ। মঞ্চের একপাশে কবিগুরুর আবক্ষ মূর্তি। দেখাশোনার কেউ নেই। ভবন দু’টির সামনে শাড়ি-লুঙ্গি শুকাতে দেয়া হয়েছে। ডাকাডাকি করায় পাশের বাড়ি থেকে এক যুবক বেরিয়ে এলেন। নাম বরুণ কুশারি। পরিচয় দিলেন কবির বংশের লোক হিসেবে। তাড়াতাড়ি কাপড় সরিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দেন। জানালেন কবিগুরুর আদিপুরুষের বসতভিটা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এর রক্ষণাক্ষেণের কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। এখন বছরে একবার হৈ হুল্লোড় করা হয়। সংগ্রহশালাটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোন কর্মচারি নেই। স্ব-উদ্যোগে বরুণই এটি দেখাশুনা করেন। তবে তার ক্ষোভ রয়েছে।
জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষের বাড়ি বলে যে দোতলা বাড়িটি চিহ্নিত করা হয়েছিল সেটি আসলে মাত্র একশ’ বছর আগে বরুণের ঠাকুর দাদা নির্মাণ করেছিলেন।
পিঠাভোগের কুশারী এবং দক্ষিণডিহির চৌধুরীদের পীরালী ব্রাম্মণে পরিণত হওয়ার কারণ নিয়ে অবশ্য দ্বিমত রয়েছে। তবে পীর আলী তাহিরের নাম থেকে যে পীরালী ব্রাম্মণের সূত্রপাত এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। খানজাহান আলীর দরগার এক খাদেম জানান, পীর আলী তাহির প্রথম জীবনে একজন হিন্দু ব্রাম্মণ ছিলেন। নাম ছিল তাঁর তারিনী চরণ কুশারী এবং পিঠাভোগ গ্রামেই ছিল তাঁর বাড়ি। নিজ গুনে তিনি হযরত খান জাহানের প্রধান খলীফা নিযুক্ত হন। পীর আলী তাহির এতটাই প্রিয়ভাজন ছিলেন যে হজরত খান জাহান তাঁর মাজার (সৌধ)’র পাশে খোলা জায়গায় অনুরূপ আর একটি সমাধি নির্মাণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর সময় পীর আলী তাহির বাগেরহাটে না থাকায় তাঁকে সেখানে সমাধিস্থ করা যায়নি। তিনি যেখানে মারা যান সেখানেই তাঁকে দ্রুত সমাধিস্থ করা হয়। শতাব্দির পর শতাব্দি এটা খালি কবর হিসেবে পরিচিত ছিল। ইদানিং মাজারের কিছু খাদেম একে সচল দাবি করে পসার জমিয়েছে। *****
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক