বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম: বিশ্বের সব বন্দরে জাহাজের আউটসাইড মুভমেন্ট নিজস্ব পাইলট দিয়ে হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তা এখন বেসরকারি পাইলটের সাহায্যে করার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে শিপিং এজেন্টদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
যে কোন বন্দর সীমানায় জাহাজের মুভমেন্ট নিজস্ব পাইলট দিয়ে হয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে। চট্টগ্রাম বন্দরের সীমানা এখন ১৫ নটিক্যাল মাইল, আগে ছিল ৭ নটিক্যাল মাইল। খোলাপণ্যবাহী বড় বড় যেসব জাহাজ আমদানি মালামাল নিয়ে আসে সেগুলো সরাসরি জেটিতে আসতে পারে না। বহির্নোঙরে কিছু মাল খালাস করে জেটিতে আসে অথবা সমূদয় পণ্য লাইটার করে ফিরে যায়। কুতুবদিয়া থেকে মাস্টার নিজেই জাহাজ নিয়ে আসে বহির্নোঙরে। সেখান থেকে যায় নির্দিষ্ট নোঙরে আলফা, ব্রেভো বা চার্লিতে। এই প্রক্রিয়া অর্ধ শতাব্দী ধরে। তবে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এর পরিবর্তে তাদের সীমানায় জাহাজের আউটসাইড মুভমেন্ট নির্দিষ্ট ৫ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা পাইলট দিয়ে পরিচালনা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বহির্নোঙরে দুর্ঘটনা প্রতিরোধের নামে ঐ ব্যবস্থা কার্যকরের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ সার্কুলার জারি করে। তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় শিপিং এজেন্টদের মধ্যে। তারা সার্কুলারটি কার্যকর করার পূর্বে শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সাথে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অনুরোধ জানান বন্দর প্রশাসনকে। বন্দর চেয়ারম্যনের সভাপতিত্বে গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একটি সভায়ও শিপিং এজেন্টদের এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়। কিন্তু তা না করে শেষপর্যন্ত কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিকুল আলম জুয়েল জানান, আলোচ্য সার্কুলারের ব্যাপারে সংগঠনের ৮ সদস্য প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছে এবং ৫৮ সদস্য যৌথভাবে আপত্তি জানিয়েছে। তারা সার্কুলারটির কার্যকারিতা স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
একটি শিপিং কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহী জানান, বহির্নোঙরে দুর্ঘটনা প্রতিরোধের অজুহাত দেখিয়ে বন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ঐ উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে। এরপরও যদি দুর্ঘটনা ঘটবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কতিপয় অবসর প্রাপ্ত পাইলটকে অন্য কোন শিপিং এজেন্ট বা তথাকথিত নেভিগেশনাল ফেসিলিটেটরের মাধ্যমে নিয়োগ করা হলেই যে বহির্নোঙরে দুর্ঘটনা বছরের পর বছর শূন্যের কোটায় থাকবে তার কোন যৌক্তিক কারণ নেই।
তিনি উল্লেখ করেন,অনেক জাহাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের পাইলটরা পাইলটিং কাজে নিয়োজিত থাকার পরও চ্যানেলের মধ্যে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। আর তাতে নিজ নিজ জাহাজ ছাড়াও অন্য জাহাজ, স্থাপনা এবং নৌ বাহিনীর প্রচুর ক্ষতির কারণে সংশ্লিষ্ট জাহাজ মালিকদেরকে কোন কোন ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। সে তুলনায় বহির্নোঙরে নৌ দুর্ঘটনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। উদ্যোগটি বন্দরের নিরাপত্তার স্বার্থে নেয়া হয়েছে না ‘বিশেষ একটি গোষ্ঠি’র পকেট ভারি করার জন্য নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
প্রাইড শিপিং লাইন্স জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নৌ বিভাগ কর্তৃক কোন এক অদৃশ্য এবং রহস্যময় কারণে পাইলট নিয়োগের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের পরিবর্তে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নামসর্বস্ব শিপিং এজেন্ট প্রতিষ্ঠ।নের হাতে তুলে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শিপিং এজেন্টরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এতে তৎকালীন চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে তা আর কার্যকর করা যায়নি। সেটা কার্যকর করার জন্য আবারও তৎপরতা শুরু হয়েছে।
শিপ ওনার এবং চার্টারাররা প্রতিটি জাহাজের প্রতিটি ভয়েজের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের সাথে তীব্র দর কষাকষি করে এজেন্ট নিয়োগ করে থাকে। পাইলটিংয়ের জন্য ৫টি নাম সর্বস্ব শিপিং প্রতিষ্ঠানকে নেভিগেশনাল ফ্যাসিলিটেটরের নামে নৌ বিভাগ কর্তৃক তালিকাভুক্তি বা নিয়োগে নতুন সিন্ডিকেট তৈরি করবে বলে আশংকা প্রকাশ করে ঐ শিপিং লাইন্স।
তালিকাভুক্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠান হলো জুনের শিপিং লাইনস, আয়ার শিপিং সার্ভিসেস, বাংলাদেশ সি গোয়িং পাইলট সার্ভিস কোম্পানি, কেএমসি শিপিং এবং ডিএমএসসি।
তালিকাভুক্ত একটির শীর্ষ নির্বাহি জানান যে তাদেরকে শতভাগ স্বচ্ছতায় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জাহাজের আউটসাইড মুভমেন্টে নতুন ব্যবস্থায় পাইলটিং হলে শিপিং এজেন্টদের এ খাতের কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে তারা বিরোধিতা করছে। কারণ, তখন আউটসাইড মুভমেন্টে পাইলটিংয়ের দর নির্দিষ্ট হয়ে যাবে। তাতে বাড়তি আদায়ের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এখন ইচ্ছামত চার্জ আদায় করা হয়। বিরোধীতাকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিও টেন্ডারে অংশ নিয়েছে। কিন্তু শর্ত পূরণ না হওয়ায় বাদ পড়ে গেছে।
কুতুবদিয়ায় লাইটারিং করা হলে আমদানিকারকের প্রতিটনে সাড়ে ৩ ডলার বেশি খরচ হয়। তা সাশ্রয়ের জন্য সেখানে কম লাইটারিং করে সাড়ে ১১ মিটার, ১২ মিটারের জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরে নিয়ে আসা হয়। সেখানে জাহাজের তলা যখন ড্রেগিং করে তখন মাস্টার জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
জাহাজের আউটসাইড মুভমেন্ট বেসরকারি খাতের পাইলট দিয়ে পরিচালনার বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান যে বহির্নোঙরে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তালিকাভুক্তিতে কোন অনিয়ম হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।