বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক
মালিকপক্ষের গাফলতির কারণেই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনার এক মাস পর বুধবার (৬ জুলাই) বিকেলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে উঠে আসে, বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষ নাশকতার অভিযোগ আনলেও তদন্তে তার প্রমাণ মেলেনি। বিস্ফোরণটি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থেকেই ঘটেছে। এ ছাড়া তদন্ত কমিটিকে ডিপো কর্তৃপক্ষের কেউই সহযোগিতা করেনি।
জানা গেছে, তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিনের কাছে ১৯ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদন এবং প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আরও ২৫৯ পাতার সংযুক্ত কাগজপত্র জমা দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সমস্যা ছিল। ডিপো তদারকিতে অব্যবস্থাপনা, মালিকপক্ষের অবহেলা, দক্ষ জনবলের অভাব এবং আইএনডিজি কোড মানা হয়নি। সেইসঙ্গে কার্গো পরিচালনায় নিয়মনীতিও মানা হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, বিএম ডিপোর এমডি মোস্তাফিজুর রহমান ও পরিচালক চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মজিবুর রহমান বিএম ডিপোর ৫১ শতাংশের মালিক এবং আল-রাজি কেমিক্যালের শতভাগের মালিক।
প্রতিবেদন সর্ম্পকে তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আমদের তিনটি বিষয়ে অনুসন্ধান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেগুলো হলো ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ, দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ এবং এ ধরনের দুর্ঘটনার প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রণোয়ন। আমরা অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজে বের করেছি, দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করেছি এবং ২০টি সুপারিশ করেছি। সেখানে বৈধ অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয়তা সর্ম্পকে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, আইনকানুনের অনুপস্থিতির যে বিষয়গুলো ছিল, সেগুলো চিহ্নিত করেছি। বিশেষ করে ডিজি কার্গো অ্যাক্ট ১৯৫৩ সংশোধনের জন্য আমরা সুপারিশ করেছি। এটি আমাদের এক নম্বর সুপারিশ ছিল। এটি সংশোধন করতে হবে আইএমডিজি কোডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আইএমডিজি কোডের সর্বশেষ ভলিউমগুলো বের হয়েছে ২০১৮ সালে। আর আমাদের আইনটি হলো ১৯৫৩ সালের।
বিস্ফোরণের পর মালিকপক্ষ ও সরকার দলীয় নেতারা নাশকতার অভিযোগ আনলেও তদন্ত কমিটি সেই ধরনের কোনো লক্ষণ বা কারণ খুঁজে পাননি। এ বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় আমরা ১৭ ধরনের নমুনা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ঢাকা ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। তাতে ওই ডিপোতে অন্য কোনো কেমিক্যালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে নিজেই জ্বলতে পারে।
তদন্ত কমিটিকে ডিপো মালিকপক্ষ কোনো সহযোগিতা করেনি জানিয়ে তিনি বলেন, ডিপোতে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ পাইনি কিংবা কোনো সফটওয়্যার পাইনি। মালিকপক্ষ জানিয়েছে, এগুলোর কোনো ব্যাকআপ ছিল না। কিন্তু আমরা এগুলো রিকভার করার চেষ্টা করেছি। এটা মালিকপক্ষের একটা ব্যর্থতা। কারণ, ২০২২ সালে ক্লাউডে বা অন্যত্র কোনো নিরাপদ জায়গায় সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ থাকবে না, এটি আধুনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যায় না। এটি মালিকপক্ষের এক ধরনের ব্যর্থতা অবশ্যই।
‘আমরা সবকিছু পর্যালোচনা করে এই রিপোর্ট তৈরি করেছি। এই রিপোর্টের একটি সীমাবদ্ধতা আমরা পেয়েছি, সেটি হলো, যারা ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রায় ১৬ জন ডিপোকর্মী দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এটি আমাদের জন্য একটা সীমাবদ্ধতা, তারা নিহত হওয়ায় আমরা তাদের বক্তব্য নিতে পারিনি। ডিপো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত উচ্চপর্যায়ের দু-একজনের সঙ্গে আমর কথা বলতে পারিনি। এর মধ্যে একজন মহাব্যবস্থাপক বিদেশ ছিলেন, আরেকজন হলেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক। তার নামে মামলা থাকায় তিনি পলাতক রয়েছেন।’
এ দুর্ঘটনার জন্য মালিকপক্ষ দায়ী কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ তো অবশ্যই দায়ী। কারণ, আমার ঘরে আগুন লাগলে আমার দায় অবশ্যই, তবে যারা এটি তদারকি করতেন তারাও তাদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেন না।
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, একটি অফডক পরিচালনার জন্য ২৫টির মতো লাইসেন্স নিতে হয়। আমরা সুপারিশ করেছি ২০১৬ সালের অফডক নীতিমালা আছে। অফডকগুলো মনিটরিংয়ের জন্য নৌমন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং টিম আছে। আমরা বলেছি, ওই কমিটিতে এই ২৫টি সংস্থার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করলে এই কমিটি মিটিং করে সুপারিশ করতে পারবে, কার লাইসেন্স হবে আর কার লাইসেন্স হবে না। এখন কোন সংস্থা লাইসেন্স দিয়েছে, কোন সংস্থা লাইসেন্স দেয়নি- এগুলো একটারটা অন্যটা জানে না। কারণ, এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার কোনো যোগাযোগ নেই।
২৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে জানিয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, তাদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যারা ঘটনার সময় সেখানে অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এক পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এর বাইরে আল-রাজি কেমিক্যালের মালিক, ওই প্রতিষ্ঠানের জিএম (মার্কেটিং)-সহ সিঅ্যান্ডএফ, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স, শিপিং লাইন এবং বিএম কন্টেইনার ডিপোর সঙ্গে জড়িতদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।
উল্লেখ্য, গত ৫ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আগুন লাগার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ডিপোটির বিভিন্ন জায়গায়। এ ঘটনায় প্রথম দুই দিনে দমকলকর্মীসহ ৪১ জন মারা যান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েকজনের মৃত্যু হয় এবং ডিপোতে কয়েকটি দেহাবশেষ পাওয়া যায়। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৫১ জনের মৃত্যু ও আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ।