বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি
সিলেট: আদালতে প্রবেশপথে হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। আশঙ্কাজনক অবস্থায় শনিবার রাতে তাকে সিলেট এমজ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ তথ্য নিশ্চিত করে সিলেটের ডিআইজি (প্রিজন) মো. ছগির মিয়া বলেন, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মারধরে তার শরীরের অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ হয়েছে। একটি অন্ডকোশ ফেটে গেছে। হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে।
তিনি বলেন, সীমান্তের আটকের সময়ই তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাকে কোর্টে তোলার আগেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দরকার ছিলো।
শনিবার বিকেল চারটার দিকে সাবেক এই বিচারপতিকে সিলেটের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-১ আলমগীর হোসেনের আদালতে নেওয়া হয়। এসময় আদালতের প্রবেশপথে তার উপর হামলার ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালতে প্রবেশের সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও আদালত প্রাঙ্গণে থাকা দলবদ্ধ কিছু ব্যক্তি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে বেধড়ক কিলঘুষি মারেন। শারীরিকভাবে তাকে লাঞ্ছিতও করা হয়। অনেকে ডিম ছোড়ার পাশাপাশি তাকে লক্ষ্য করে জুতাও নিক্ষেপ করেন। কেউ কেউ শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে ‘ভুয়া ভুয়া’-সহ বিভিন্ন কটূক্তিমূলক স্লোগান দেন।
পরে আদালতে তোলা হলে আদালত তাএক ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেন। আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার পথে সেনাবাহিনীর পাহারা থাকায় তখন কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি।
এর আগে, শুক্রবার রাতে অবৈধভাবে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাবেক বিচারপতি মানিককে আটক করে বিজিবি।
বিচারপতি মানিক স্থানীয়দের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা দিয়েঅৈভেধভাবে ভারত পালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে জানা যায়। আটকের পর স্থানীয়রা তাকে মরদর করে ও টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শনিবার ভোরের দিকে সিলেটের কানাইঘাট দনা সীমান্ত বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা তাকে কানাইঘাট থানায় হস্তান্তর করেন। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জানা গেছে, ২১ আগস্ট শামসুদ্দিন চৌধুরী কানাইঘাট উপজেলার আটগ্রামে অবস্থান নেন। নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করে দেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় দালালদের সহযোগিতা নেন। পরে তাঁদের সঙ্গেই গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সীমান্ত পাড়ি দিতে হেঁটে রওনা হন।
প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পর সীমান্তের একটি জঙ্গলে দালালেরা শামসুদ্দিন চৌধুরীকে রেখে চলে যান। ওই রাতে তিনি জঙ্গলে একাই ছিলেন। শুক্রবার সকালে তাঁকে ভারতে পাঠানোর কথা জানিয়েছিলেন দালালেরা। তবে স্থানীয় মানুষের তৎপরতায় সেটি আর হয়নি।
শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটকের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন সীমান্তবর্তী ডনা খাদিমপাড়া গ্রামের বিলাল আহমেদ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান, এক ব্যক্তিকে অবৈধভাবে ভারতের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ানো হচ্ছে- এমন তথ্য এলাকাবাসী পান ২১ আগস্ট। কিন্তু বিষয়টির সত্যতা তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে জানতে পারেন, দালালেরা ওই ব্যক্তিকে ভারতের সীমান্তবর্তী একটি জঙ্গলে নিয়ে রেখে এসেছেন বৃহস্পতিবার। সেটি জানতে পেরে তাঁরা সীমান্ত এলাকায় খোঁজাখুঁজি করে শুক্রবার বিকেলের দিকে এক ব্যক্তির অস্তিত্ব জঙ্গলে পান। তবে দালালদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
শুক্রবার বিকালে স্থানীয় লোকজন জঙ্গলে গিয়ে দেখেন, এক ব্যক্তি কলাপাতা উপর শুয়ে আছেন। এরপর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্থানীয় লোকজন জানতে পারেন- তিনি পালিয়ে অবৈধভাবে ভারতে চলে যেতে চাইছেন। তবে দালালেরা তাঁকে মারধর করে সঙ্গে থাকা প্রচুর টাকা নিয়ে পালিয়েছেন। পরে বিজিবিকে বিষয়টি জানানো হয়। স্থানীয় লোক মারফত খবর পেয়ে সন্ধ্যার দিকে বিজিবির টহল দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান এবং রাত সাড়ে নয়টার দিকে শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটক করে বিজিবির ডনা ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে ডনা ক্যাম্পের আশপাশে উৎসুক মানুষেরা ভিড় জমে যায়।
ডনা বিজিবি ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার মহিবউল্লা জানান, ক্যাম্পে এনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর শামসুদ্দিন চৌধুরীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরপরই বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে।
শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটকের সময়ের দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে- জঙ্গলের মতো একটি স্থানে শামসুদ্দিন ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় কলাপাতায় শুয়ে আছেন। তাঁর পরনে গাঢ় নীল চেকের হাফহাতা শার্ট আর মাটিমাখা ময়লা-ভেজা প্যান্ট।
ভিডিওতে একজনের উদ্দেশে শামসুদ্দিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি তোমাদের পয়সা দিয়ে দেব।’ উত্তরে ব্যক্তিটি বলেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ শামসুদ্দিন এরপর বলেন, ‘পয়সা আমি দেব। আমার ভাই-বোনেরা দিয়ে দেবে।’
জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের পয়সার কোনো প্রয়োজন নেই। ঠিক আছে? আপনি যদি সেফটি মানে…।’ কথার মাঝখানে ওই ব্যক্তিকে থামিয়ে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ওই ফালতু লোক দুইটারে আনিও না। আমি এই দেশে (ভারত) এত কষ্ট করে এসেছি কি বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য?’
শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটক করার পরের আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি শামসুদ্দিনের গলায় থাকা গোলাপি রঙের মাফলার ধরে আছেন। তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হচ্ছে। শামসুদ্দিনকে তখন আতঙ্কিত, ভীত ও হতাশ দেখাচ্ছিল। ওই ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাড়ি মুন্সিগঞ্জ।’ এরপর নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার নাম বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।’
তখন একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক? ওই মানিককা…, যে কয় দিন আগে একজন উপস্থাপককে ইয়ে করছে? চ্যানেল আইতে?’ তখন শামসুদ্দিন বলেন, ‘হ্যাঁ।’ প্রশ্নকর্তা এবার পিতার নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পিতার নাম মরহুম আবদুল হাকিম চৌধুরী।’ প্রশ্নকর্তা এরপর বলেন, ‘আবদুল হাকিম চৌধুরী। গুড। আফনে ইন্ডিয়া পালাইতেছিলেন কেনে? বলেন?’ শামসুদ্দিন বলেন, ‘ভয়ে পালাইতেছি।’
প্রশ্নকর্তা ‘কার ভয়ে’ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে শামসুদ্দিন বলেন, ‘প্রশাসনের ভয়ে।’ প্রশ্নকর্তা এবার বলেন, ‘ওই যে একটি মেয়েকে (উপস্থাপক) বলেছিলেন ইয়ের বাচ্চা।’ পাশ থেকে আরেকজন বলেন, ‘দীপ্তি চৌধুরীকে বলেছিলেন।’ শামসুদ্দিন তখন বলেন, ‘তার জন্য আমি ক্ষমাও চেয়েছি। আমি বলি আপনারে, আমি ইয়ের রোগী…’। শার্ট তুলে শামসুদ্দিন তখন বুকের অস্ত্রোপচারের ক্ষত দেখানোর চেষ্টা করলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্নকর্তা বলেন, ‘কত রোগী…মিডিয়াতে তো খুব সুন্দর কথা বলেন।’ এ সময় আরেকজন প্রশ্নকর্তা বলেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা শোনেন, আপনাকে যখন ধরেছে, তখন কী কী ছিল আপনার সাথে?’
শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার সাথে ছিল ব্রিটিশ পাসপোর্ট, বাংলা পাসপোর্ট, টাকা, কয়টা ডেবিট কার্ড আর ক্রেডিট কার্ড।’ এরপর প্রশ্নকর্তা আবার প্রশ্ন করেন, ‘কালকে যে টাকাগুলো ছিল, আজকে কি কোনো টাকা ছিল সাথে?’ শামসুদ্দিন এর জবাবে বলেন, ‘আজকে টাকা ছিল না। কত জানি, ৪০ হাজার টাকা ছিল।’ প্রশ্নকর্তা এরপর জানতে চান, ‘কালকে যে দুজন টাকা নিয়েছিল, ওদের কাছে কত টাকা ছিল?’ শামসুদ্দিন বলেন, ‘ধরেন ৬০-৭০-এর মতো। ওরা নিয়ে গেছে।’ প্রশ্নকর্তা জানতে চান, ‘৬০-৭০ লাখ?’ শামসুদ্দিন বলেন, ‘হ্যাঁ।’
প্রশ্নকর্তা জানতে চান, ‘নৌকাওয়ালাও সাথে নিয়ে গেছে?’ শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘না, ওই দুই ছোকরা নিছে। আর কেউ ছিল না।’ প্রশ্নকর্তা এবার বলেন, ‘ওনাদের ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে? যারা নিছে?’ শামসুদ্দিন বলেন, ‘না, কিচ্ছু নাই। আমার ফোন নম্বরটম্বর সব নিয়ে গেছে।’ প্রশ্নকর্তা এবার জানতে চান, ‘আপনি কত টাকা কন্ট্রাক্টে আসছেন?’ শামসুদ্দিন জবাবে বলেন, ‘আমি ১৫ হাজার টাকা ওদের বলছিলাম। ওইটা আমি দিছি। কিন্তু পরে ওই দুই ছেলে আমারে মাইরাধইরা টাকা নিয়ে গেছে।’
তখন অন্য আরেক ব্যক্তি জানতে চান, ‘এই মাইরটা কোন জায়গাত মারছে, ভাইয়া? বর্ডারে আইনা মারছে, না?’ শামসুদ্দিন জবাবে বলেন, ‘না, ভিতরে।’ ওই প্রশ্নকর্তার এবার জিজ্ঞাসা, ‘তারার ভিতরে? ইন্ডিয়ার ভিতরে।’ শামসুদ্দিন বলেন, ‘ইন্ডিয়ার ভিতরে।’ এবার আরেকজন প্রশ্ন করেন, ‘আপনে তো আমাদের বাংলাদেশের অনেকের নামে অনেক অন্যায় করেছেন, জুলুম করেছেন। এটা সঠিক?’ শামসুদ্দিন উত্তরে বলেন, ‘আমি জুলুম করি নাই। বিচারপতি হিসেবে যেগুলো রায় করার, সেগুলো দিছি।’
তখন একজন বিজিবি সদস্য বাধা দিয়ে বলেন, ‘এইগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় চলবে। এ কথা বলতে পারি না। বাকি যা জিজ্ঞাসা করার আমাদের ঊর্ধ্বতনরা জিজ্ঞাসা করবেন। চলেন আমরা যাই।’