।। রেজাউল করিম।।
আবদুল আজিজ, বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি। ১৯৭১ এ ছিলেন কিশোর। অন্য অনেক কিশোরের মতো তিনিও যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ৫০ বছর পরে এখনও তার কাছে তাজা সেই স্মৃতি। বলছিলেন তখনকার বৃষ্টিস্নাত এক দিনের কথা।
‘বৃষ্টির দিন। পুরো রাস্তা কাদা। একে তো খাবারের অভাব, আরেকদিকে ক্লান্তি। এক পা সামনে গেলে, আরেক পা পেছনে চলে যায়। ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছি সবাই। টানা পাঁচদিন পেটে ভাত জোটেনি। চিঁড়া-গুড় খেয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি,’ আজিজের কণ্ঠে সেই একাত্তরের দৃঢ়তা।
‘একদিন রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধার বাড়িতে কিছু খাবার চাইলাম। বৃদ্ধা তিনটি চিতই পিঠা আমাদের খেতে দিলেন। এর মধ্যে আমরা জানতে পারলাম, বৃদ্ধা একজন ভিক্ষুক। সারাদিন ভিক্ষা করে তিনি খাবার যোগাড় করেন। আমরা যদি তার খাবার খেয়ে ফেলি তাহলে তাকে না খেয়ে থাকতে হবে আজ। তাই আমরা খেতে চাইলাম না।’
কিন্তু ওই বৃদ্ধ নারী তা মানতে চাইলেন না। কারণ এরাতো মুক্তিযোদ্ধা, বলছেন আজিজ, ‘তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘বাবা, তোমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করছো। তোমাদের খাওয়াতে পারা আমার জন্য সৌভাগ্যের। তোমরা যদি আমার পিঠা না খাও, তাহলে আমি জীবনে আর কোনদিনও খাবো না; তোমাদের সামনেই আমি আত্মহত্যা করে মারা যাবো।’ তারপর আমরা তার তিনটি পিঠা ভাগভাগি করে খেলাম।’
আজিজ এখনও ভুলতে পারেন না সেই বৃদ্ধার কথা। ‘মাঝে মাঝেই সেই বৃদ্ধার কথা আমার মনে হয়। তখন মনের অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। মনে হয়, সেদিন শুধু আমরা দেশকে ভালোবাসার জোরেই চৌকশ পাকিস্তানি সেনাদের ঘায়েল করে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিলাম।’ এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করলেন জামালপুরের সরিষাবাড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ।
আর ৫০ বছর পরের এখনকার বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করতেই আজিজ বললেন, ‘তখনকার বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখন বাংলাদেশে একটা মানুষও না খেয়ে মারা যান না। তখনকার সময় আর এখনকার সময়ের মধ্যে এটিই বড় পার্থক্য।’
এক সময় যে দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর ৫০ বছর পর এখন সেই দেশ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ‘উদীয়মান অর্থনীতির মডেল’। তবে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে বহুদিন এই রাষ্ট্র টিকবে কি-না তা নিয়ে উন্নত বিশ্বের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল।
এখন বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিবিদরা উন্নয়নের উদাহরণ টানতে গিয়ে বাংলাদেশের কথা বলেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাও শুরু হয়েছে। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে।
পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যায়, স্বাধীনতার সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। আর বর্তমানে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে নেমেছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিভিন্ন দেশ থেকে ত্রাণ সহযোগিতা এনে বাংলাদেশের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে হয়েছিল। আর এখন বিশ্ব কৃষি উৎপাদনের অনেকগুলো শীর্ষ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশ দেশের কাতারে। কৃষিতে আজ নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হচ্ছে বাংলাদেশেই। আজ বাঙালিরা পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করছেন।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ। আর ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতির দেশের কাতারে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
আজ অনেক সূচকেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১ সালের মে মাসে কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৫.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে। আর জুন মাসে পাকিস্তানের রিজার্ভ ১৭.১ বিলিয়ন ডলার হয়।
২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দুই হাজার ২২৭ ডলারে উন্নীত হয়। এদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় হলো এক হাজার ৫৪৩ ডলার।
বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি সমৃদ্ধ ছিল। আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি সমৃদ্ধ। সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৫০ বছরে ২৭১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাত্র দুই দশকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে।
পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পাকিস্তানের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। এছাড়া সামাজিক ও মানব সম্পদসহ অনেকগুলো সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানও একই কথা বলেন। তিনি বলছেন, ‘স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সেটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, পাশাপাশি সামাজিক নানা সূচকে। বাংলাদেশে বিশাল উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি হয়েছে। গ্রামের সাধারণ কৃষকেরা কৃষির উৎপাদন বিপুলভাবে বাড়িয়েছেন।’
স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বনির্ভরতা- মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ।
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধোত্তীর্ণ দেশ, চরম দারিদ্র্য, রাস্তাঘাট ভাঙা, ব্রিজ ভাঙা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এসব নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। এগুলো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থা থেকে আমরা উত্তীর্ণ হতে পারবো কি-না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সবাই বলতো, আমরা সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না। আমাদেরও আত্মবিশ্বাস ছিল না যে পারবো। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যে, আমরা তখন পুরোপুরি পরনির্ভরশীল ছিলাম।’
তবে এই অবস্থায় আসা বাংলাদেশের জন্য সহজ ছিল না। শুরুতে কৃষি খাত, পরে মূল ভূমিকা রাখতে শুরু করে শিল্প খাত- বললেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, বাংলাদেশ গত পঞ্চাশ বছরে মানবসম্পদ সূচকেও গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করেছে। জাতিসংঘের সূচকে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৭৩.২ শতাংশ। এই সূচকের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মূলত শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫৩ জন। যেটি ২০১৮ সালে এসে প্রতি হাজারে মাত্র ২২ জনে নেমে আসে। এ ছাড়া বিবিএস ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়েছে প্রতি হাজারে ২১২ জন। যেটি ২০১৮ সালে হয়েছে প্রতি হাজারে ২৯। ১৯৯১ সালে মাতৃ মৃত্যুর হার ছিল ৪.৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
তবে এত অর্জনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তির যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আজ কি সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে?- প্রশ্ন রেখেছেন রেহমান সোবহান।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মুক্তির সংগ্রামে’ যে মুক্তির কথা বলা হয়েছিল, তা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র-এই চার মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মুক্তি অর্জনের জন্য লড়াই সমাপ্ত হয়নি। এখনও অনেক পথ বাকি আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন এগিয়েছে তেমন সমান তালে এগিয়েছে আয়বৈষম্য। আইন ও নীতিও সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ হয় না। আয় যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে বৈষম্য। নায্যতার সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হলে আয়বৈষম্যও কমে আসবে।’
সেই ক্ষোভ আছে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজেরও। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও এখন মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও বিবেকের অভাব রয়েছে। দেশকে ভালোবাসেন না বলেই এখন মানুষে মানুষে এত বিভেদ, এত বৈষম্য। শক্তিমত্তার বিচার করলে পাকিস্তানের সেনাদের সঙ্গে আমরা কোনদিনও পেরে উঠতাম না। যে শক্তি তাদের বিরুদ্ধে পেরে উঠতে সাহায্য করেছিল, তা হলো ভালোবাসা। দেশের প্রতি আমাদের অগাধ ভালোবাসা ছিল। সেই ভালোবাসার জোরেই আমরা জয়ী হয়েছিলাম।’
-সৌজন্যে দৈনিক সংবাদ